রাহাত মামুন
চট্টগ্রাম সংবাদদাতা
চট্টগ্রামের পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সোমবার (১ মার্চ) সকাল সোয়া ১০টা থেকে এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযান নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট। এছাড়া দায়িত্ব পালন করছেন এক হাজারেরও বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
এদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির স্থায়ী পরিষদের সভাপতি জসিমউদ্দীন চৌধুরী, কার্যনির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. শেখ শফিউল আযম ও মহাসচিব এইচ এম মুজিবুল হক শুক্কুর এক বিবৃতিতে লালদিয়ারচর বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করার দাবি জানিয়েছেন।
উচ্ছেদ অভিযান শুরু আগে এক ব্রিফিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছেন। যারা আছেন, তারা এখন যাচ্ছেন। যারা এখনও নিজেদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে পারেননি, সাহায্য চাইলে আমরা সে সহায়তা দিতেও রাজি আছি। বাসিন্দারা নিজেরাই সরে যাওয়ায় আমাদের জোর করে উচ্ছেদ করতে হচ্ছে না। আজ শুধু আমাদের (বন্দরের) জায়গাটুকু চিহ্নিত করে বেড়া দিয়ে দেয়া হবে।’
বাসিন্দাদের পূণর্বাসন না করে চলছে অভিযান, চরম আতংক আর হতাশা নিয়ে বাপ-দাদার ভিটে চাড়ছে। এ যেন দেখার কেউ নেই।
এক সময়কার প্রভাবশালী মেম্বারের একমাত্র নাতনি হয়েও আজ ফারজানার নিজের কোন বাড়ি নেই। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই কোলের শিশুকে নিয়ে অশ্রুশিক্ত কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘কেমন যে আছি নিজেও জানি না। কিভাবে বাঁচবো তাও জানি না।’
বাস্তবতার নির্মম পরিহাস মেনে নিয়েই নিজের জন্মস্থান ও পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে ফারজানাকে। তার মনের নিরব কান্না শোনার মত কেউ নেই। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশ মানতে আজ সোমবার লালদিয়ার চরের সব স্থাপনা উচ্ছেদ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সান্ত্বনা দিয়ে ফারজানার কাছে জানতে চাওয়া হয় লালদিয়ার চরে তাদের পৈত্রিক বসবাস প্রসঙ্গে। তিনি জানান, হোসাইন আহমেদ মেম্বার তার দাদা। আজকের জহুরুল হক বিমান ঘাঁটিতে ছিল হোসাইন আহমেদ মেম্বারের বাড়ি। মেম্বার হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত ছিলেন তিনি।
কিন্তু ১৯৭২ সালে তৎকালীন মুজিব সরকারের আমলে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের সময় স্থায়ী বন্দোবস্তি পাওয়ার আশ্বাসের ভিত্তিতে নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে লালদিয়ার চরে বসতি শুরু করে স্থানীয় হোসাইন আহমেদ মেম্বারসহ কয়েকশ পরিবার। এই লালদিয়ার চড়ে ১৯৯৬ সালে হোসাইন আহমেদের ছেলে মো. রফিকের ঘরে জন্ম হয় একমাত্র মেয়ে ফারজানার। লালদিয়ার চরের তার বাপ-দাদার বাড়িটি ফারজানার নামেই লিখে দিয়েছেন। এখন নয় মাসের শিশুপূত্রকে নিয়ে ফারজানা তার পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে পতেঙ্গার কাটগড়ে একটি ভাড়া বাসায় উঠছেন। কিন্তু ভাড়া বাসা কতদিন চালাতে পারবেন তা জানেন না ফারজানা। তার স্বামী ক্যাবল নেটওয়ার্কের (ডিস) কাজ করেন। যা আয় হয় তা দিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে সংসার চালানো অসম্ভব প্রায়।
এই চিত্র শুধু ফারজানা একার নয়। লালদিয়ার চরে বসবাসকারী প্রায় ২৩শ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষের প্রত্যেকেই এখন ফারজানার মত করুণ অবস্থা।
গতকাল রবিবার দুপুরে পতেঙ্গার এয়ারপোর্ট রোড সংলগ্ন লালদিয়ার চড়ের ১২ নম্বর ঘাটের পাশে গিয়ে দেখা যায় প্রায় সব বসতঘর ও দোকানের সব মালামাল বের করে নিয়েছে বাসিন্দারা। ভ্যান ও শত শত পিকআপ সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানো। সেগুলোতে মালামাল ভর্তি করা হচ্ছে। কেউ ঘরের চালার টিন নিচ্ছে, কেউ কেউ ইট দরজা জানালা খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কেউ তাদের রোপণ করা গাছটিও কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে যাওয়ার মাঝে যে হৃদয় ক্ষরণ তা তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। পুনর্বাসন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনেকেই জানান, তাদের কবে থাকার জায়গা দেবে সরকার তারা তা জানেন না। এমনকি কেউ তাদের খোঁজও নিতে আসেন নি।