চীনে আক্রান্ত হওয়ার পর বিশ্বের ১০৪ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১ লাখ ৭ হাজার ৭৩৬ জন। মারা গেছে ৩ হাজার ৬৬১ জন। দিন দিন নতুন নতুন দেশ যুক্ত হচ্ছে করোনা আক্রান্তের তালিকায়। সবশেষ রোববার (৮ মার্চ) বাংলাদেশেও তিন জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
করোনা প্রতিরোধে সরকারের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও আগ্রহের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (৭ মার্চ) রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ফখরুল বলেন, ‘করোনা সারা পৃথিবীতেই মানুষের শুধু ক্ষতি করছে তা নয়, এটা অর্থনীতির ওপরেও প্রচণ্ড রকমের বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অথচ সরকারের এই বিষয়ে আগ্রহ কম। ফলে এখানে এই ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
এর পরদিন রোববার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকার ২৪ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। যেকোনো জায়গায় সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তবে সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে। এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
এই রোগে আক্রান্ত হলে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে পরিস্থিতি চরম হতে পারে, সেটি ধরে নিয়েই করোনা প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে উচ্চপর্যায়ের তিনটি কমিটি গঠন করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের পাশাপাশি সব হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারেও মনিটরিং করা হচ্ছে। ঢাকার বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তারা এসব বিষয়ে বৈঠকে বসছেন।
তারা জানান, যেহেতু ১০৩টি দেশের মধ্যে ৪৩ দেশে স্থানীয় সংক্রমণের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছে, সে কারণে স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে দেশের বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে আসা ৫ লক্ষাধিক যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। সন্দেহজনক হলে তাকে আইসোলেশনে রেখে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেন আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করে আলাদা করে ফেলা সম্ভব হয়।
আইইডিসিআরের পরিচালক প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমাদের মূল কৌশলই হচ্ছে রোগীকে শনাক্ত করে দ্রুত আলাদা করে নেওয়া। তিনি বলেন, আমাদের জনগণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য বিভাগ সরকার কখনোই কিছু করতে পারবে না, যদি জনগণ সচেতন হয়ে অংশগ্রহণ না করে।
এদিকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহ হলে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ মানে হচ্ছে ‘সেলফ কোয়ারেন্টাইন’ উল্লেখ করে ফ্লোরা বলেন, ‘বিষয়টা হচ্ছে নিজেকে নিজের কোয়ারেন্টাইন করা।’
করোনায় আক্রান্তের সন্দেহ হলে, লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে সরাসরি আইইডিসিআর না এসে বাড়িতে বসেই হটলাইনে ফোন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাড়িতে বসে হটলাইনে ফোন করলে সব শুনে নমুনা সংগ্রহে বাড়িতে পৌঁছে যাবে আইইডিসিআরের টিম।
এক প্রশ্নের জবাবে মীরজাদা সেব্রিনা বলেন, আমাদের যেহেতু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, তাই এই ঘনবসতি এলাকা দেখেই কিন্তু বেশি আশঙ্কাটা করি। সেজন্যই আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইনের কথা বলছি। আমরা আশঙ্কা করছি না যে, অনেক বেশি সংখ্যায় কেস হয়ে যাবে, দ্রুত ছড়িয়ে যাবে। তবে চরম হতে পারে ভেবেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। সেরকম যদি পরিস্থিতি দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই স্কুল-কলেজ বা অফিস বন্ধ করা, গণপরিবহন বন্ধ করা, জনসমাগম বন্ধ করা- এ ধরনের কার্যক্রম নেওয়া হবে। সেগুলো আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে আছে।
রোববার (৮ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. ফ্লোরা বলেন, দেশে তিনজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া পর্যবেক্ষণে রয়েছেন দুইজন। যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের দুইজন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। দেশে এলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত একজনের মাধ্যমে পরবর্তীতে একই পরিবারের আরও এক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন।
‘তিনজনের মধ্যে একজন নারী, দুইজন পুরুষ। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে,’ যোগ করেন তিনি।
ডা. ফ্লোরা বলেন, বাংলাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার মতো কোনো পরিস্থিতি হয়নি। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার মতোও সময় আসেনি। তবে করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজন না হলে জনসমাগমে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। তার মতে, ‘করোনা প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া আছে। আইসোলেশেন ইউনিট করা হয়েছে।’
শনাক্ত হওয়ার পরে সেই রোগীকে ফলো করার পরামর্শ দিয়ে ফ্লোরা বলেন, ‘সেই রোগীর স্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টাইন রাখা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ’
কোনও কোনও যাত্রীর অভিযোগ তাদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে না—এই প্রসঙ্গে ফ্লোরা বলেন, স্ক্যানার মেশিন এমনভাবে বসানো যে বিদেশ থেকে আসা সব যাত্রীকে এটার ভেতর দিয়ে আসতে হবে। স্ক্রিনিং করা হচ্ছে কিন্তু তারা অনেকেই বুঝতে পারছেন না যে তাদের স্ক্রিনিং হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তবে ওই স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে শুধু যাত্রীর জ্বর বোঝা যায়। অন্য কোনও সমস্যা আছে কিনা, তা জানার জন্য আমরা একটা ফর্ম দেই। ওই ফর্ম থেকেই আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। অনেকে ফর্ম জমা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না, আবার অনেকে মোবাইল নম্বরও দেন না। ফর্মে অবশ্যই মোবাইল নম্বর উল্লেখ করতে বলা হয়। যেন সার্বক্ষণিক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হসপিটাল এন্ড ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আমরা পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু করেছি। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল আইসোলেশন রাখার জন্য আমরা সব ধরনের ইনস্ট্রাকশন দিয়েছি। প্রাইভেট হাসপাতালোর সঙ্গেও একাধিকবার বৈঠক করেছি।’ হাসপাতালে কয়টি বেড থাকলে কয়টি আইসোলেশন বেড হবে, তাও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো, বার বার হাত ধোয়া; ৩ ফুট দূরত্ব রাখা; হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা; জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ও সচেতন থাকা।