ঢাকা ০২:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বাকেরগঞ্জের পাদ্রীশিবপুরে বড় পুইয়াউটা গ্রামে বাইতুন নাজাত জামে মসজিদের শুভ উদ্ভোধন। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে সকলকে সজাগ থাকতে হবে-লায়ন গনি মিয়া বাবুল সোনারগাঁয়ে শম্ভুপুরা ইউনিয়ন ৯নং ওয়ার্ড আ’লীগের কার্যালয়ের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭ তম জন্মদিন উপলক্ষে এম ইসফাক আহসানের এর উদ্যোগে রেলি ও আলোচনা সভা আইন পেশায় সর্বোচ্চ খেতাব ” আপিল বিভাগের আইনজীবী ” হিসেবে ভূষিত হলেন এডভোকেট রেজাউল করিম। সোনারগাঁয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর শুভ জন্মদিন উপলক্ষ্যে আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত সোনারগাঁয়ে রবিন ও সাজুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বাগেরহাটে ফকিরহাটে সড়ক যেন মরণ ফাঁদ, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন আমান উল্লাহ পাড়া জামে মসজিদে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত বাকেরগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষ্যে মিলাদ মাহাফিল ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত।

আমি চাইলাম যারে…

আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বাউল সাধক কফিলউদ্দিনের মৃতুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করে এই লেখা।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জনপদ আধ্যাত্মিক নগর সিলেট। সুফি, মরমি, বৈষ্ণব, সাধু, ফকিরেরা এ অঞ্চলকে করেছেন গরীয়ান। কালোত্তীর্ণ এই তীর্থভূমির সুপুরুষদেরই একজন কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর রচিত প্রায় পাঁচ হাজার গানের মধ্যে জনপ্রিয় একটি হলো-‘আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে, সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে।’

প্রান্তিক জনপদেও সাধক বা মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। যাঁরা জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণের বার্তা দিয়েছেন কবিতায়, গানের বাণীতে। এমনই এক সাধক কবি ‘জ্ঞানের সাগর’ খ্যাত দুরবিন শাহের অন্যতম শিষ্য কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান কণ্ঠে তুলে খ্যাতি অর্জন করেছেন বহু কণ্ঠশিল্পী। তবু সিলেটের বাইরে তিনি রয়ে গেলেন অচেনা, অজানা। এক হাতে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাকে। ঠোঁটের সাহায্যে তাঁর মন্দিরা বাজানোর দৃশ্যে হৃদয়ে দাগ কাটে। অল্প সময়ে যেকোনো বিষয়ে গান লিখে দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।

১৯৩২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের মালঞ্চপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, মা করিমুন্নেসা। এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০ বছর বয়স থেকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

শিশুকাল থেকে রাত জেগে পালাগান শুনতে শুনতেই গানের জগতে প্রবেশ। যৌবনের সন্ধিক্ষণে গান লিখতে শুরু করেন। একতারা, দোতারা বাজিয়ে গাইতেন নিজের এবং বিভিন্ন মহাজনি গান। যৌবনকালে আখমাড়াইয়ের মেশিনে বাঁ হাতটি থেঁতলে যায়, কেটে ফেলতে হয় কনুই পর্যন্ত। বহু দুঃখ-দুর্দশায় জীবন কাটালেও থেমে থাকেনি তাঁর কণ্ঠ। শাহ আবদুল করিম, কামাল উদ্দিন, নেত্রকোনার সাত্তার মিয়াসহ অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে গেয়েছেন। একসময় মালজোড়া গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

জগৎ এবং প্রাত্যহিক জীবনের মানবিক তাত্পর্য, মানবপ্রেম ও স্রষ্টাপ্রেম উদ্ভাসিত হয় তাঁর রচনায়। সুফি দর্শন, বাউল দর্শন ও সাধনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল তিনি। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল তাঁর বড় ধর্ম। সহজ ভাবনায়, সাদামাটা জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, নির্লোভ ও সরলতা প্রতিভাত হয় তাঁর চলনে-বলনে।

১৯৬৭ সালে প্রথম গীতিগ্রন্থ রত্নভার ছাড়াও আরও সাতটি বই প্রকাশিত হয় তাঁর জীবদ্দশায়। দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, জলভরা, রূপতত্ত্ব, বাঁশি, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মিলন, নিবেদন, ভাটিয়ালি, ভক্তিমূলক, রাধাকৃষ্ণ, আঞ্চলিক গান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন।

বাংলার মরমি সংগীতের অগ্রগণ্য বাউল গায়ক কফিলউদ্দিন সরকার ‘তত্ত্বের ভান্ডার’ নামে পরিচিতি লাভ করেন তাঁর অসামান্য দক্ষতায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজস্ব ভাবনা-রুচিবোধ-সমাজভাবনা-মনুষ্যত্ববোধ ও আনন্দ-বেদনা তুলে ধরেন গানে। তাঁর গীতবাণী নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গানগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

কফিলউদ্দিন সরকার ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিলেটের একটি হাসপাতালে। লোকসাহিত্যের নিভৃতচারী এই নক্ষত্র পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন নীরবে। কিন্তু আমাদের হৃদয়বীণায় বেজে ওঠে তাঁরই কণ্ঠে আকুল করা সেই গান-

‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, বাঁচি না পরানে গো, একেলা ঘরে রইতে পারি না’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বাকেরগঞ্জের পাদ্রীশিবপুরে বড় পুইয়াউটা গ্রামে বাইতুন নাজাত জামে মসজিদের শুভ উদ্ভোধন।

আমি চাইলাম যারে…

আপডেট টাইম ০৯:০৮:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বাউল সাধক কফিলউদ্দিনের মৃতুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করে এই লেখা।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জনপদ আধ্যাত্মিক নগর সিলেট। সুফি, মরমি, বৈষ্ণব, সাধু, ফকিরেরা এ অঞ্চলকে করেছেন গরীয়ান। কালোত্তীর্ণ এই তীর্থভূমির সুপুরুষদেরই একজন কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর রচিত প্রায় পাঁচ হাজার গানের মধ্যে জনপ্রিয় একটি হলো-‘আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে, সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে।’

প্রান্তিক জনপদেও সাধক বা মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। যাঁরা জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণের বার্তা দিয়েছেন কবিতায়, গানের বাণীতে। এমনই এক সাধক কবি ‘জ্ঞানের সাগর’ খ্যাত দুরবিন শাহের অন্যতম শিষ্য কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান কণ্ঠে তুলে খ্যাতি অর্জন করেছেন বহু কণ্ঠশিল্পী। তবু সিলেটের বাইরে তিনি রয়ে গেলেন অচেনা, অজানা। এক হাতে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাকে। ঠোঁটের সাহায্যে তাঁর মন্দিরা বাজানোর দৃশ্যে হৃদয়ে দাগ কাটে। অল্প সময়ে যেকোনো বিষয়ে গান লিখে দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।

১৯৩২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের মালঞ্চপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, মা করিমুন্নেসা। এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০ বছর বয়স থেকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

শিশুকাল থেকে রাত জেগে পালাগান শুনতে শুনতেই গানের জগতে প্রবেশ। যৌবনের সন্ধিক্ষণে গান লিখতে শুরু করেন। একতারা, দোতারা বাজিয়ে গাইতেন নিজের এবং বিভিন্ন মহাজনি গান। যৌবনকালে আখমাড়াইয়ের মেশিনে বাঁ হাতটি থেঁতলে যায়, কেটে ফেলতে হয় কনুই পর্যন্ত। বহু দুঃখ-দুর্দশায় জীবন কাটালেও থেমে থাকেনি তাঁর কণ্ঠ। শাহ আবদুল করিম, কামাল উদ্দিন, নেত্রকোনার সাত্তার মিয়াসহ অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে গেয়েছেন। একসময় মালজোড়া গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

জগৎ এবং প্রাত্যহিক জীবনের মানবিক তাত্পর্য, মানবপ্রেম ও স্রষ্টাপ্রেম উদ্ভাসিত হয় তাঁর রচনায়। সুফি দর্শন, বাউল দর্শন ও সাধনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল তিনি। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল তাঁর বড় ধর্ম। সহজ ভাবনায়, সাদামাটা জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, নির্লোভ ও সরলতা প্রতিভাত হয় তাঁর চলনে-বলনে।

১৯৬৭ সালে প্রথম গীতিগ্রন্থ রত্নভার ছাড়াও আরও সাতটি বই প্রকাশিত হয় তাঁর জীবদ্দশায়। দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, জলভরা, রূপতত্ত্ব, বাঁশি, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মিলন, নিবেদন, ভাটিয়ালি, ভক্তিমূলক, রাধাকৃষ্ণ, আঞ্চলিক গান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন।

বাংলার মরমি সংগীতের অগ্রগণ্য বাউল গায়ক কফিলউদ্দিন সরকার ‘তত্ত্বের ভান্ডার’ নামে পরিচিতি লাভ করেন তাঁর অসামান্য দক্ষতায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজস্ব ভাবনা-রুচিবোধ-সমাজভাবনা-মনুষ্যত্ববোধ ও আনন্দ-বেদনা তুলে ধরেন গানে। তাঁর গীতবাণী নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গানগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

কফিলউদ্দিন সরকার ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিলেটের একটি হাসপাতালে। লোকসাহিত্যের নিভৃতচারী এই নক্ষত্র পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন নীরবে। কিন্তু আমাদের হৃদয়বীণায় বেজে ওঠে তাঁরই কণ্ঠে আকুল করা সেই গান-

‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, বাঁচি না পরানে গো, একেলা ঘরে রইতে পারি না’