ঢাকা ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড বাসস্ট্যান্ড তীব্রতাপ প্রভায়ে খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ বগুড়া শাজাহানপুরে অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও “দেশ টিভির সাংবাদিককে লিগ্যাল নোটিশ” বাকেরগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় কলেজ শিক্ষার্থীর পায়ের পাতা বিচ্ছিন্ন। বাকেরগঞ্জের সাহেবপুরে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসখার নামাজ আদায়। উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রচারে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কুমিল্লা,মুরাদনগরে-৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে জবাই করে হত্যা। ভবেরচর ইউনিয়নের ৩নংওর্য়াডে আনারস মার্কার উঠান বৈঠক ও মিছিল অনুষ্ঠিত : নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড বাসস্ট্যান্ড তীব্রতাপ প্রভায়ে খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ –রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম এলাকা হতে ৪০৬ ক্যান বিয়ারসহ ০১ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে

লাল বাসে মন দেওয়া-নেওয়া, তারপর…

জাহিদ হাসান লাল রঙা কিছু দেখার পর হয়তো তা অনেকক্ষণ মানসপটে ভেসে থাকে। বাসের রঙ লাল হওয়ার বিশেষত্ব কি এখানেই? বাইরের অনেক দেশেই হলুদ রঙের স্কুলবাসের প্রচলন রয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের ব্লগে ‘why school bus never comes in red or green’ শিরোনামে একজন লিখেছেন, ‘হলুদ রঙকে মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময় স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে। একই সঙ্গে বিভিন্ন আবহাওয়ায় হলুদ রঙে কোনো পরিবর্তন হয় না। হলুদ রঙের গাড়ি রাস্তা দিয়ে চললে মানুষ বুঝে নেয় এটা স্কুল বাস।’ ঠিক তেমনি ঢাকা শহরে লাল রঙের বিশেষ গাড়ি চললে নাম না দেখেও অনেকে বলে দিতে পারেন, এটা  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের বাস।

যেভাবে ঐতিহ্যের অংশ হলো লাল বাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সালে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও জিএসের উদ্যোগে পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতায় ভারতের বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) একটি বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয়। চাহিদা ছিল, বাসের ডিজাইন হতে হবে ইউনিক, যে রকম বাস ইতিমধ্যে বাংলাদেশে দেখা যায়নি, বাসের রঙ হবে রক্ত লাল। তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের একজন নামকরা প্রকৌশলী বাসের নকশা তৈরি করেন।

১৯৮১ সালে ৭টি লাল বাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিবহন ব্যবস্থা চালু করে। বাসের সামনে সাদা রঙে বাংলা অক্ষরে লেখা ছিল, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। ঢাকার রাস্তায় বাসগুলো এক প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতিগতভাবে সাধারণ মানুষ এই লাল রঙকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিহা বলছিলেন, ‘আসলে লাল বাসতো কেবল একটি বাস নয়, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একে মহিমান্বিত করেছে, বিশেষায়িত করেছে। গণপরিবহনের অন্যান্য লাল বাস আমাদের মনে সে অনুভূতি জাগায় না। কারণ, এটি স্বপ্নের বাস, আকাঙ্ক্ষার বস্তু।’

এক বুক স্বপ্ন, রোমাঞ্চ আর উদ্দীপনা নিয়ে প্রথম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় পা রাখে শিক্ষার্থীরা। সময়ের পরিক্রমায় ক্লাসরুম থেকে শুরু করে বটতলা, শ্যাডো, কার্জন কিংবা টিএসসি-এসব কিছুই হয়ে ওঠে তাদের জীবনের অংশ।

আবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাস জীবনের যোগসূত্র তৈরির প্রথম মাধ্যম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, তেমনি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাসের প্রথম ভালোবাসা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস।

ক্ষণিকা বাসের যাত্রী প্রথম বর্ষের সাকিব বলেন, ‘প্রথম এই লাল বাসে যেদিন উঠি, সেদিনের অনুভূতি ছিল অন্যরকম। এই লাল বাসটা বাস্তবে শুধুই একটা বাহন, কিন্তু আমার কাছে আশা আর উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে। লাল বাসে চড়ার স্বপ্ন আমাকে ঘুমোতে দেয়নি।’

কার্জন হলে প্রবেশ পথের উল্টোপাশে অথবা মল চত্বরে স্বাগত জানায় লালরঙা বাসের সারি। তাদের রয়েছে বাহারি সব নাম, আলাদা পরিচয়! উল্লাস, ক্ষণিকা, চৈতালি, তরঙ্গ, কিঞ্চিৎ মৈত্রী, আনন্দ- এমন সব নাম। আছে বাংলা মাস ও ঋতুর নামও! বৈশাখী, শ্রাবণ, ফাল্গুনী, হেমন্ত, বসন্ত! বাদ যায়নি বারো ভূঁইয়াও! বাসের নাম যে ঈশা খাঁ! মজার ব্যাপার হলো, কর্তৃপক্ষ নয়, শিক্ষার্থীরাই এসব নামকরণের মাধ্যমে লাল বাসগুলোকে আরো রাঙিয়ে তোলে।

লাল রঙা এই বাসগুলোর সদস্যরা এক একটি পরিবার। প্রতিটি বাসেই গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন মেয়াদের কমিটি। ফেসবুক পেজে বাসের সময়সূচিতে পরিবর্তন জানানো থেকে শুরু করে বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে বার্ষিক বনভোজন, নবীনবরণ, ইফতার পার্টি, বাসের কোনো শিক্ষার্থীর জন্য টিউশন, ব্লাড বা অর্থ সাহায্যের প্রয়োজনেও সর্বদা একে-অন্যের পাশে।

‘প্রথম বর্ষে ক্লাস চলাকালীন মায়ের ফোন আসে। মা বললেন, তোমার আব্বুকে হসপিটালে ভর্তি করেছি, তুমি দ্রুত চলে আসো।’ ক্লাস থেকে দৌড়ে বের হলাম ৩টা ১০ মিনিটে মৈত্রী বাস ধরার জন্য। আমি কলাভবনের গেটে আসতে আসতে বাস তখন রোকেয়া হলের সামনে। তখন এক ভাইয়া এসে জিজ্ঞাস করলেন, আপু কী বাস মিস করেছেন? আমি হ্যাঁ বলা মাত্রই ভাইয়া দৌড়ে গিয়ে রোকেয়া হলের সামনে বাস থামিয়ে রাখলেন আমার জন্য। আমি বাস পেলাম, বাসায় এলাম। বাবার সাথে দেখা করতে পেরেছি শেষবারের জন্য। আমি যদি বাস না পেতাম, অথবা লোকালে আসতাম, তাহলে হয়তো আর দেখা করা হতো না বাবার সাথে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যেত। সেই অপরিচিত ভাইয়া এবং এই লাল বাসের প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ’। বেশ আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইশরাত জান্নাত।

বাসের সিট তো বটেই, গেটও উপচে থাকে শিক্ষার্থীদের দ্বারা। গেটে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা কীভাবে গেলে দ্রুত যাওয়া যাবে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন, কখনো বা ট্রাফিক পুলিশকে সিগন্যাল ছাড়ানোর অনুরোধ করেন।

‘জ্যামের একঘেয়েমি কাটাতে সবাই মিলে যখন বাসের গেটে গান ধরেন, হোক সেটা সুরো কিংবা বেসুরো গলায়, তখন আর ক্লান্তিবোধটা থাকে না। ভার্সিটিলাইফ শেষে ব্যাপারগুলো খুব মিস করব’ বলছিলেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী প্লাবন।

২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা পরিসংখ্যান বিভাগের আশফাকের লাল বাসের স্মৃতিটা একটু অন্যরকম। তিনি বলেন, ‘আমি এই লাল বাসের সাবেক যাত্রী, লালবাস আমাকে আমার জীবনের সেরা একটি উপহার দিয়েছে। লাল বাসের এক রমণীর সাথে মন দেওয়া-নেওয়া, প্রেম-ভালোবাসা, পরিণতি বিয়ে! স্মৃতিতে অমলিন এই লাল বাস।’

ফিন্যান্সের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফ বলেন, ‘দু-এক মিনিটের জন্য কতবার যে বাস মিস করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! এই লাল বাসের সাথে রেস প্রতিযোগিতায় আমি কখনো ক্লান্ত হই না।’

ইসলামিক স্টাডিজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসমিয়া বলছিলেন, ‘গণপরিবহনে উঠলে দুর্ঘটনার ভয় সবসময় কাজ করে, আর হ্যারেজমেন্টের ব্যাপারটা আছেই। কিন্তু এই লাল বাসে নিজেকে কেন জানি খুব নিরাপদ মনে হয়।’

দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গণভবনে গিয়েছিলেন এই লাল বাসে চড়েই।

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট বাড়ানো হচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাসের পরিমাণ বাড়ানোটা কর্তৃপক্ষের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আবাসন সংকটই নয়, পরিবহনের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানামুখী সংকট। নিজস্ব বাসের পাশাপাশি তাই বিআরটিসির ভাড়া বাসের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন, যার জন্যে প্রতিবছর গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা।

সাধারণের কাছে এই বাসগুলো হয়তো কেবলই শিক্ষার্থী বহনকারী লালরঙা বাহন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এই বাস এক টুকরো লাল-আবেগ।

দিন শেষে লাল বাসই হয়তো বলে ওঠে, ‘আমি আড়ম্বরপূর্ণ কিছু নই, আমার এসি নেই, নেই ভালো আসনও, সবার জন্য নির্ধারিত জায়গাও নেই, অনেক সময় হয়তো দাঁড়িয়ে কিংবা ঝুলে যেতে হয়। তারপরও অনেকে স্বপ্ন বুনতে থাকে আমার কোলে বসে, আমার প্রতি তোমাদের যে দরদ তা অনুভব করি ক্যাম্পাস বন্ধের দিনগুলোতে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (২য় বর্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Tag :

জনপ্রিয় সংবাদ

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড বাসস্ট্যান্ড তীব্রতাপ প্রভায়ে খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ

লাল বাসে মন দেওয়া-নেওয়া, তারপর…

আপডেট টাইম ০৮:১৪:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ ২০২০
জাহিদ হাসান লাল রঙা কিছু দেখার পর হয়তো তা অনেকক্ষণ মানসপটে ভেসে থাকে। বাসের রঙ লাল হওয়ার বিশেষত্ব কি এখানেই? বাইরের অনেক দেশেই হলুদ রঙের স্কুলবাসের প্রচলন রয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের ব্লগে ‘why school bus never comes in red or green’ শিরোনামে একজন লিখেছেন, ‘হলুদ রঙকে মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময় স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে। একই সঙ্গে বিভিন্ন আবহাওয়ায় হলুদ রঙে কোনো পরিবর্তন হয় না। হলুদ রঙের গাড়ি রাস্তা দিয়ে চললে মানুষ বুঝে নেয় এটা স্কুল বাস।’ ঠিক তেমনি ঢাকা শহরে লাল রঙের বিশেষ গাড়ি চললে নাম না দেখেও অনেকে বলে দিতে পারেন, এটা  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের বাস।

যেভাবে ঐতিহ্যের অংশ হলো লাল বাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সালে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও জিএসের উদ্যোগে পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতায় ভারতের বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) একটি বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয়। চাহিদা ছিল, বাসের ডিজাইন হতে হবে ইউনিক, যে রকম বাস ইতিমধ্যে বাংলাদেশে দেখা যায়নি, বাসের রঙ হবে রক্ত লাল। তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের একজন নামকরা প্রকৌশলী বাসের নকশা তৈরি করেন।

১৯৮১ সালে ৭টি লাল বাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিবহন ব্যবস্থা চালু করে। বাসের সামনে সাদা রঙে বাংলা অক্ষরে লেখা ছিল, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। ঢাকার রাস্তায় বাসগুলো এক প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতিগতভাবে সাধারণ মানুষ এই লাল রঙকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিহা বলছিলেন, ‘আসলে লাল বাসতো কেবল একটি বাস নয়, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একে মহিমান্বিত করেছে, বিশেষায়িত করেছে। গণপরিবহনের অন্যান্য লাল বাস আমাদের মনে সে অনুভূতি জাগায় না। কারণ, এটি স্বপ্নের বাস, আকাঙ্ক্ষার বস্তু।’

এক বুক স্বপ্ন, রোমাঞ্চ আর উদ্দীপনা নিয়ে প্রথম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় পা রাখে শিক্ষার্থীরা। সময়ের পরিক্রমায় ক্লাসরুম থেকে শুরু করে বটতলা, শ্যাডো, কার্জন কিংবা টিএসসি-এসব কিছুই হয়ে ওঠে তাদের জীবনের অংশ।

আবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাস জীবনের যোগসূত্র তৈরির প্রথম মাধ্যম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, তেমনি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাসের প্রথম ভালোবাসা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস।

ক্ষণিকা বাসের যাত্রী প্রথম বর্ষের সাকিব বলেন, ‘প্রথম এই লাল বাসে যেদিন উঠি, সেদিনের অনুভূতি ছিল অন্যরকম। এই লাল বাসটা বাস্তবে শুধুই একটা বাহন, কিন্তু আমার কাছে আশা আর উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে। লাল বাসে চড়ার স্বপ্ন আমাকে ঘুমোতে দেয়নি।’

কার্জন হলে প্রবেশ পথের উল্টোপাশে অথবা মল চত্বরে স্বাগত জানায় লালরঙা বাসের সারি। তাদের রয়েছে বাহারি সব নাম, আলাদা পরিচয়! উল্লাস, ক্ষণিকা, চৈতালি, তরঙ্গ, কিঞ্চিৎ মৈত্রী, আনন্দ- এমন সব নাম। আছে বাংলা মাস ও ঋতুর নামও! বৈশাখী, শ্রাবণ, ফাল্গুনী, হেমন্ত, বসন্ত! বাদ যায়নি বারো ভূঁইয়াও! বাসের নাম যে ঈশা খাঁ! মজার ব্যাপার হলো, কর্তৃপক্ষ নয়, শিক্ষার্থীরাই এসব নামকরণের মাধ্যমে লাল বাসগুলোকে আরো রাঙিয়ে তোলে।

লাল রঙা এই বাসগুলোর সদস্যরা এক একটি পরিবার। প্রতিটি বাসেই গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন মেয়াদের কমিটি। ফেসবুক পেজে বাসের সময়সূচিতে পরিবর্তন জানানো থেকে শুরু করে বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে বার্ষিক বনভোজন, নবীনবরণ, ইফতার পার্টি, বাসের কোনো শিক্ষার্থীর জন্য টিউশন, ব্লাড বা অর্থ সাহায্যের প্রয়োজনেও সর্বদা একে-অন্যের পাশে।

‘প্রথম বর্ষে ক্লাস চলাকালীন মায়ের ফোন আসে। মা বললেন, তোমার আব্বুকে হসপিটালে ভর্তি করেছি, তুমি দ্রুত চলে আসো।’ ক্লাস থেকে দৌড়ে বের হলাম ৩টা ১০ মিনিটে মৈত্রী বাস ধরার জন্য। আমি কলাভবনের গেটে আসতে আসতে বাস তখন রোকেয়া হলের সামনে। তখন এক ভাইয়া এসে জিজ্ঞাস করলেন, আপু কী বাস মিস করেছেন? আমি হ্যাঁ বলা মাত্রই ভাইয়া দৌড়ে গিয়ে রোকেয়া হলের সামনে বাস থামিয়ে রাখলেন আমার জন্য। আমি বাস পেলাম, বাসায় এলাম। বাবার সাথে দেখা করতে পেরেছি শেষবারের জন্য। আমি যদি বাস না পেতাম, অথবা লোকালে আসতাম, তাহলে হয়তো আর দেখা করা হতো না বাবার সাথে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যেত। সেই অপরিচিত ভাইয়া এবং এই লাল বাসের প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ’। বেশ আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইশরাত জান্নাত।

বাসের সিট তো বটেই, গেটও উপচে থাকে শিক্ষার্থীদের দ্বারা। গেটে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা কীভাবে গেলে দ্রুত যাওয়া যাবে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন, কখনো বা ট্রাফিক পুলিশকে সিগন্যাল ছাড়ানোর অনুরোধ করেন।

‘জ্যামের একঘেয়েমি কাটাতে সবাই মিলে যখন বাসের গেটে গান ধরেন, হোক সেটা সুরো কিংবা বেসুরো গলায়, তখন আর ক্লান্তিবোধটা থাকে না। ভার্সিটিলাইফ শেষে ব্যাপারগুলো খুব মিস করব’ বলছিলেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী প্লাবন।

২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা পরিসংখ্যান বিভাগের আশফাকের লাল বাসের স্মৃতিটা একটু অন্যরকম। তিনি বলেন, ‘আমি এই লাল বাসের সাবেক যাত্রী, লালবাস আমাকে আমার জীবনের সেরা একটি উপহার দিয়েছে। লাল বাসের এক রমণীর সাথে মন দেওয়া-নেওয়া, প্রেম-ভালোবাসা, পরিণতি বিয়ে! স্মৃতিতে অমলিন এই লাল বাস।’

ফিন্যান্সের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফ বলেন, ‘দু-এক মিনিটের জন্য কতবার যে বাস মিস করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! এই লাল বাসের সাথে রেস প্রতিযোগিতায় আমি কখনো ক্লান্ত হই না।’

ইসলামিক স্টাডিজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসমিয়া বলছিলেন, ‘গণপরিবহনে উঠলে দুর্ঘটনার ভয় সবসময় কাজ করে, আর হ্যারেজমেন্টের ব্যাপারটা আছেই। কিন্তু এই লাল বাসে নিজেকে কেন জানি খুব নিরাপদ মনে হয়।’

দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গণভবনে গিয়েছিলেন এই লাল বাসে চড়েই।

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট বাড়ানো হচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাসের পরিমাণ বাড়ানোটা কর্তৃপক্ষের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আবাসন সংকটই নয়, পরিবহনের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানামুখী সংকট। নিজস্ব বাসের পাশাপাশি তাই বিআরটিসির ভাড়া বাসের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন, যার জন্যে প্রতিবছর গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা।

সাধারণের কাছে এই বাসগুলো হয়তো কেবলই শিক্ষার্থী বহনকারী লালরঙা বাহন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এই বাস এক টুকরো লাল-আবেগ।

দিন শেষে লাল বাসই হয়তো বলে ওঠে, ‘আমি আড়ম্বরপূর্ণ কিছু নই, আমার এসি নেই, নেই ভালো আসনও, সবার জন্য নির্ধারিত জায়গাও নেই, অনেক সময় হয়তো দাঁড়িয়ে কিংবা ঝুলে যেতে হয়। তারপরও অনেকে স্বপ্ন বুনতে থাকে আমার কোলে বসে, আমার প্রতি তোমাদের যে দরদ তা অনুভব করি ক্যাম্পাস বন্ধের দিনগুলোতে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (২য় বর্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।