কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে এবং বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এআই অর্থনীতি, জনসেবা এবং মানবজীবনের মান উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। তবে এআই-এর উত্থানের সাথে নৈতিক দিক এবং সামাজিক প্রভাবও জড়িত হয়েছে, যা সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এআই-এর সুফল যাতে সমাজের সকল স্তরে পৌঁছায় এবং এর নেতিবাচক প্রভাব যাতে কমানো যায়, সেজন্য এই দিকগুলো বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে এআই ক্রমশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রবেশ করছে। এই প্রযুক্তি আমাদের দেশের বহু জটিল সমস্যার সমাধানের একটি সম্ভাবনাময় উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেমন, দূরবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং আরও বেশি মানুষকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা।
এআই চালিত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্রুত ও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব, বিশেষ করে যেসব এলাকায় চিকিৎসকের সংখ্যা কম। আবার, এআই ব্যবহার করে কৃষকরা আবহাওয়া, ফসলের রোগ এবং বাজারের খবর সহজেই পেতে পারে, ফলে তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পারে।
যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত আমাদের জীবনে প্রবেশ করছে, তা কিছু গুরুতর নৈতিক প্রশ্নও তুলে ধরেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষপাতিত্ব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলো সাধারণত এমন তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় যেখানে সব ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব হয় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এতে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অন্যদের চেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারে, যার ফলে সমাজে অসাম্য আরও বাড়তে পারে। ধরুন, কোনো নিয়োগ সংস্থা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের নির্বাচন করে এবং সেটি গ্রামীণ এলাকার মানুষের প্রতি পক্ষপাতী হয়, তাহলে বর্তমান বৈষম্য আরও গভীর হতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক চিন্তা হল গোপনীয়তা। এআই সিস্টেমগুলোকে কার্যকর করতে প্রচুর তথ্যের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে, যেখানে ডেটা সুরক্ষা আইন এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়, ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঝুঁকি সবসময়ই থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এআই চালিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে। ফলে, এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে সমাজ একটি নজরদারি সমাজে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির আগমন সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। এআই দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, যার ফলে শ্রমবাজারে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। অনেক খাতে এআই-চালিত যন্ত্রপাতি মানুষের কাজ কেড়ে নেওয়ার ফলে বেকারত্ব বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে কম দক্ষতার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ও উৎপাদন খাতে এআই-চালিত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাতের কাজের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে আমাদের সমাজকে প্রভাবিত করছে, এর নৈতিক দিকগুলো কী এবং এটি আমাদের সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, সেগুলো বুঝতে হলে আমাদের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। এআই আমাদের দেশের উন্নয়নে অনেক সম্ভাবনা বয়ে আনলেও, এর সাথে জড়িত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
একদিকে যেমন এআই শিল্পের বৃদ্ধি বাংলাদেশে এআই ডেভেলপার, ডেটা বিশ্লেষক এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞদের মতো নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে এই চাকরিগুলোতে কাজ করার জন্য বিশেষ ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন। দেশের অনেক শ্রমিকের কাছে এই দক্ষতা অর্জন করা কঠিন হওয়ায় একটি নতুন দক্ষতার ব্যবধান তৈরি হচ্ছে এবং এতে সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যাপক ব্যবহার আমাদের সামাজিক যোগাযোগ এবং সম্পর্কের ধরনকে গভীরভাবে বদলে দিতে পারে। এআই চালিত যোগাযোগ মাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়া আমাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া পদ্ধতি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, যার ফলে সমাজে একাকীত্ব বাড়তে পারে এবং ঐতিহ্যবাহী সামাজিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে, আইন প্রয়োগ বা সামাজিক সেবা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এআই-এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষের দায়িত্ববোধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে তুলতে পারে। এর ফলে মানুষ যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে, যা একদিন মানুষের দ্বারা নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে ক্রমশ যন্ত্রের হাতে তুলে দেয়।
বাংলাদেশে এআই-এর সম্ভাবনা অসীম। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এআই আমাদের দেশে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এআই ব্যবহার করে আমরা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তথ্য ও সেবা পৌঁছে দিতে পারি, যা আগে তাদের নাগালের বাইরে ছিল।
এআই চালিত প্ল্যাটফর্মগুলো নাগরিকদের সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের মতামত জানাতে সাহায্য করতে পারে, যা আমাদের গণতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় করবে। এছাড়া, এআই দরিদ্র ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত মানুষদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা প্রদান করে সামাজিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের একটি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এআই-এর প্রভাব মূলত সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসেবা খাতে এআই ব্যবহার করার সময় স্বাস্থ্যসমতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এর জন্য সামাজিক কারণগুলো যেমন আর্থিক সামর্থ্য, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করা জরুরি। একইভাবে, শিক্ষাক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত, যাতে এআই-চালিত শিক্ষা সিস্টেম বর্তমান শিক্ষা বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে না তোলে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর বিকাশ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিক বিবেচনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি, যা ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করবে এবং এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এছাড়া, সরকারি সংস্থা ছাড়াও নাগরিক সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে এআই-সম্পর্কিত নীতি ও কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে এআই প্রযুক্তি আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
এআই প্রযুক্তির সমাজতাত্ত্বিক দিকগুলো বিবেচনা করতে গেলে শিক্ষা ও জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে এআই এর সুবিধা ও ঝুঁকি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে আমরা তাদের এআই এর সাথে নিরাপদ ও কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করতে পারি। এছাড়া, এআই শিল্পে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দিয়ে আমরা এআই এর সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারি। এজন্য বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা জরুরি।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে আমাদের সমাজকে প্রভাবিত করছে, এর নৈতিক দিকগুলো কী এবং এটি আমাদের সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, সেগুলো বুঝতে হলে আমাদের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। এআই আমাদের দেশের উন্নয়নে অনেক সম্ভাবনা বয়ে আনলেও, এর সাথে জড়িত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
তাই, আমাদেরকে এআই-এর সুবিধা গ্রহণ করার পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিকগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এআই-এর বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে পারব যেখানে এআই-এর সুবিধা সবাই উপভোগ করতে পারবে এবং কোনো ধরনের অসাম্য থাকবে না।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।
বাংলাদেশে এআই ক্রমশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রবেশ করছে। এই প্রযুক্তি আমাদের দেশের বহু জটিল সমস্যার সমাধানের একটি সম্ভাবনাময় উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেমন, দূরবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং আরও বেশি মানুষকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা।
এআই চালিত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্রুত ও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব, বিশেষ করে যেসব এলাকায় চিকিৎসকের সংখ্যা কম। আবার, এআই ব্যবহার করে কৃষকরা আবহাওয়া, ফসলের রোগ এবং বাজারের খবর সহজেই পেতে পারে, ফলে তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পারে।
যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত আমাদের জীবনে প্রবেশ করছে, তা কিছু গুরুতর নৈতিক প্রশ্নও তুলে ধরেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষপাতিত্ব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলো সাধারণত এমন তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় যেখানে সব ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব হয় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এতে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অন্যদের চেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারে, যার ফলে সমাজে অসাম্য আরও বাড়তে পারে। ধরুন, কোনো নিয়োগ সংস্থা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের নির্বাচন করে এবং সেটি গ্রামীণ এলাকার মানুষের প্রতি পক্ষপাতী হয়, তাহলে বর্তমান বৈষম্য আরও গভীর হতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক চিন্তা হল গোপনীয়তা। এআই সিস্টেমগুলোকে কার্যকর করতে প্রচুর তথ্যের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে, যেখানে ডেটা সুরক্ষা আইন এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়, ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঝুঁকি সবসময়ই থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এআই চালিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে। ফলে, এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে সমাজ একটি নজরদারি সমাজে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির আগমন সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। এআই দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, যার ফলে শ্রমবাজারে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। অনেক খাতে এআই-চালিত যন্ত্রপাতি মানুষের কাজ কেড়ে নেওয়ার ফলে বেকারত্ব বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে কম দক্ষতার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ও উৎপাদন খাতে এআই-চালিত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাতের কাজের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে আমাদের সমাজকে প্রভাবিত করছে, এর নৈতিক দিকগুলো কী এবং এটি আমাদের সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, সেগুলো বুঝতে হলে আমাদের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। এআই আমাদের দেশের উন্নয়নে অনেক সম্ভাবনা বয়ে আনলেও, এর সাথে জড়িত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
একদিকে যেমন এআই শিল্পের বৃদ্ধি বাংলাদেশে এআই ডেভেলপার, ডেটা বিশ্লেষক এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞদের মতো নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে এই চাকরিগুলোতে কাজ করার জন্য বিশেষ ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন। দেশের অনেক শ্রমিকের কাছে এই দক্ষতা অর্জন করা কঠিন হওয়ায় একটি নতুন দক্ষতার ব্যবধান তৈরি হচ্ছে এবং এতে সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যাপক ব্যবহার আমাদের সামাজিক যোগাযোগ এবং সম্পর্কের ধরনকে গভীরভাবে বদলে দিতে পারে। এআই চালিত যোগাযোগ মাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়া আমাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া পদ্ধতি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, যার ফলে সমাজে একাকীত্ব বাড়তে পারে এবং ঐতিহ্যবাহী সামাজিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে, আইন প্রয়োগ বা সামাজিক সেবা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এআই-এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষের দায়িত্ববোধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে তুলতে পারে। এর ফলে মানুষ যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে, যা একদিন মানুষের দ্বারা নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে ক্রমশ যন্ত্রের হাতে তুলে দেয়।
বাংলাদেশে এআই-এর সম্ভাবনা অসীম। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এআই আমাদের দেশে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এআই ব্যবহার করে আমরা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তথ্য ও সেবা পৌঁছে দিতে পারি, যা আগে তাদের নাগালের বাইরে ছিল।
এআই চালিত প্ল্যাটফর্মগুলো নাগরিকদের সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের মতামত জানাতে সাহায্য করতে পারে, যা আমাদের গণতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় করবে। এছাড়া, এআই দরিদ্র ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত মানুষদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা প্রদান করে সামাজিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের একটি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এআই-এর প্রভাব মূলত সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসেবা খাতে এআই ব্যবহার করার সময় স্বাস্থ্যসমতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এর জন্য সামাজিক কারণগুলো যেমন আর্থিক সামর্থ্য, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করা জরুরি। একইভাবে, শিক্ষাক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত, যাতে এআই-চালিত শিক্ষা সিস্টেম বর্তমান শিক্ষা বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে না তোলে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর বিকাশ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিক বিবেচনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি, যা ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করবে এবং এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এছাড়া, সরকারি সংস্থা ছাড়াও নাগরিক সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে এআই-সম্পর্কিত নীতি ও কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে এআই প্রযুক্তি আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
এআই প্রযুক্তির সমাজতাত্ত্বিক দিকগুলো বিবেচনা করতে গেলে শিক্ষা ও জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে এআই এর সুবিধা ও ঝুঁকি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে আমরা তাদের এআই এর সাথে নিরাপদ ও কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করতে পারি। এছাড়া, এআই শিল্পে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দিয়ে আমরা এআই এর সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারি। এজন্য বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা জরুরি।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে আমাদের সমাজকে প্রভাবিত করছে, এর নৈতিক দিকগুলো কী এবং এটি আমাদের সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, সেগুলো বুঝতে হলে আমাদের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। এআই আমাদের দেশের উন্নয়নে অনেক সম্ভাবনা বয়ে আনলেও, এর সাথে জড়িত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
তাই, আমাদেরকে এআই-এর সুবিধা গ্রহণ করার পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিকগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এআই-এর বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে পারব যেখানে এআই-এর সুবিধা সবাই উপভোগ করতে পারবে এবং কোনো ধরনের অসাম্য থাকবে না।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।