১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান জুড়ে এক অদ্ভুত কেলেঙ্কারির ইতিহাস রচিত হয়। প্রণীত হয় ইনডেমনিটি বিল। ইনডেমনিটি হলো কোনো বিচারকার্যকে বাঁধা প্রদান সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বা আইন। কোনো অভিযান বা অভ্যুত্থানের ক্ষয়ক্ষতি আদালত বহির্ভূত রাখার জন্য আইনসভা যে বিল পাস করে তাকেই ইনডেমনিটি বিল বলে। এই শব্দের অর্থ শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা অর্থাৎ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, সেই অধ্যাদেশ যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। জিয়ার দ্বারা সংবিধানে কলঙ্ক লেপনের দিনটি কেন আমরা স্মরণ করছি? কারণ এটি প্রণয়ন করেছিলেন খুনিদের প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদ আর বৈধতা দিয়েছিলেন আরেক খুনি জিয়া। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে এ আইন প্রণীত হয়।শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি।সেই নিষ্ঠুরতার যাঁতাকলে মানুষ পিষ্ঠ হতে থাকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত।১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের অক্টোবর অবধি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার বিচার ব্যবস্থা উন্নতি করলেও পুনরায় ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চলা বিচারহীনতার দাপটে জনগণকে নিমজ্জিত হতে হয় গভীর সংকটে।সে সময় মিথ্যা মামলা দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর চেহারা আত্মপ্রকাশ করে আজকের বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার মধ্য দিয়ে।
২০০৭ সালে ‘‘কেন বন্দি মুজিব দুহিতা’’ কবিতায় কবি মহাদেব সাহা জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এভাবে-‘শেখ হাসিনা কেন কারাবন্দি এই কথা বলতে বলতে/দেখি মুক্তিযোদ্ধার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,/হাত থেকে পড়ে যায় অন্নথালা/দেখি দুঃখে তার বিরান হয়ে যায় শস্যক্ষেত্র, জলশূন্য হয়ে পড়ে দিঘি সরোবর/পিতৃমাতৃভ্রাতৃ হারা বাংলার সবচেয়ে দুঃখী মানুষ/তার কে আছে আপন আর এই মাটি ও মানুষ ছাড়া?/এমন যে দুঃখী মানুষ যার দুটি চোখ সর্বক্ষণ অশ্রুর নদী/৭ই মার্চ আর ২১-এ ফেব্রুয়ারির এই স্বাধীন বাংলাদেশে/সেই চিরদুঃখী তোমার কন্যা আজ কারাবন্দি, হায় পিতা।’ প্রকৃতপক্ষে এদেশের মাটি ও মানুষ ছাড়া তাঁর আপন আর কে আছে?আর এজন্যই জনগণ সেদিন জেগে উঠেছিল।বন্দি শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল।একইবছর শেখ হাসিনার বন্দিদশা নিয়ে ‘‘আশাহত হবার তো কথা নেই’’ কবিতায় আনোয়ারা সৈয়দ হক লিখেছিলেন-‘আশাহত হবার তো কথা নেই/মশালের লাল ঐ জ্বলছে/পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাকেই/এ কথাই সকলে বলছে।’ আসলে গ্রেফতার হওয়া শেখ হাসিনা সেদিন দুঃসহ জেল-যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে অমৃতের সন্ধান এনে দিয়েছিলেন জনগণকে।আর একারণেই ১৬ জুলাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস হলেও শেখ হাসিনার জন্য দিনটি অবিনাশী সাহস আর প্রত্যয়ে অভিষিক্ত। তবে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য ভয়ঙ্কর একটি চ্যালেঞ্জের দিনও।কারণ সেদিন তাঁকে বিতর্কিত করে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার হীন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল।যদিও সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় এদেশের প্রতিবাদী জনগণ।আর এজন্যই দিনটি স্মরণীয়।
বিজ্ঞাপন
আজ শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপের সপ্তদশ বার্ষিকী।এই দিনটি এদেশের ইতিহাসে ‘গণতন্ত্র অবরুদ্ধ ও হত্যা প্রচেষ্টা দিবস’ হিসেবে বহুল পরিচিত।২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে ধানমন্ডির নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের জন্য সুধাসদনের চতুর্দিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। চুপ করে ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। গ্রেফতারের আগে নেত্রীর নামে একাধিক মামলা দেয়া হয়। বাসা থেকে তাঁকে পুলিশের একটি জিপে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত এলাকায় তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশবাহিনীর দায়িত্বহীনতার কারণে তিনি নাজেহালের শিকার হন। সেদিন সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। সেই সকালে অনেক রাজনৈতিক কর্মী কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। আদালতে শেখ হাসিনার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত কয়েকটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে ওই সব মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
গ্রেফতারের পরই বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, কবিরা কবিতায় সরব হন। প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করানোর দাবি জানান। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে কারাবন্দি শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালের ১১ জুন আট সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কান ও চোখের চিকিৎসা নেন। দেশে ফেরার পর আবার তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।কারাবরণের পর প্রায় ১ বছর বন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা।তবে ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দেয়া মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করলেও, শেখ হাসিনা পরবর্তীতে সেই অভিযোগ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়, সৎ নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়- তাও প্রমাণিত হয়েছে।
আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার সংগ্রামী জীবনে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে দুঃখের কষ্টিপাথরে সহিষ্ণুতার দীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমানিশার দুর্যোগে প্রাণ বাঁচানোর দুঃসহ স্মৃতি; অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম- কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন; শুরু হলো আরেক জীবন। সেই জীবনের স্মৃতি আছে তাঁর রচনায়, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে।
বঙ্গবন্ধুর ৩ হাজার ৫৩ দিন জেল জীবনে কারা-মুক্তি দিবস একাধিক হলেও আমরা ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারিকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে তাঁর জেল জীবনের সমাপ্তি টেনে দিবসটিকে মুক্ত স্বদেশের মুক্তির বারতায় তাঁর নিঃশ্বাস নেবার অন্যতম দিন হিসেবে চিহ্নিত করি। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের বন্দি জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন তাঁর কারা-মুক্তি দিবস। বঙ্গবন্ধু ও ম্যান্ডেলা উভয়েই নিপীড়ক শাসকের কারা প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন বন্দি থেকেও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির চিন্তায় নিবেদিত ছিলেন। অনুরূপভাবে শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসকদের দ্বারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও কারা-যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগ্যবশত। কারণ স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক শাসক থাকার কথা ছিল না, দেশও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ দেশ-বিদেশে টিকে থাকা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা তখনও সক্রিয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের একাধিকবার চেষ্টা চলেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র পর থেকেই যা ২০২২ পর্যন্ত ২১ বার বলে তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয়। এমনকি সাবজেলে থাকার সময় ‘স্লো পয়জনিংয়ে’ তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
২০০৭ সালে ‘‘কেন বন্দি মুজিব দুহিতা’’ কবিতায় কবি মহাদেব সাহা জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এভাবে-‘শেখ হাসিনা কেন কারাবন্দি এই কথা বলতে বলতে/দেখি মুক্তিযোদ্ধার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,/হাত থেকে পড়ে যায় অন্নথালা/দেখি দুঃখে তার বিরান হয়ে যায় শস্যক্ষেত্র, জলশূন্য হয়ে পড়ে দিঘি সরোবর/পিতৃমাতৃভ্রাতৃ হারা বাংলার সবচেয়ে দুঃখী মানুষ/তার কে আছে আপন আর এই মাটি ও মানুষ ছাড়া?/এমন যে দুঃখী মানুষ যার দুটি চোখ সর্বক্ষণ অশ্রুর নদী/৭ই মার্চ আর ২১-এ ফেব্রুয়ারির এই স্বাধীন বাংলাদেশে/সেই চিরদুঃখী তোমার কন্যা আজ কারাবন্দি, হায় পিতা।’ প্রকৃতপক্ষে এদেশের মাটি ও মানুষ ছাড়া তাঁর আপন আর কে আছে?আর এজন্যই জনগণ সেদিন জেগে উঠেছিল।বন্দি শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল।একইবছর শেখ হাসিনার বন্দিদশা নিয়ে ‘‘আশাহত হবার তো কথা নেই’’ কবিতায় আনোয়ারা সৈয়দ হক লিখেছিলেন-‘আশাহত হবার তো কথা নেই/মশালের লাল ঐ জ্বলছে/পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাকেই/এ কথাই সকলে বলছে।’ আসলে গ্রেফতার হওয়া শেখ হাসিনা সেদিন দুঃসহ জেল-যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে অমৃতের সন্ধান এনে দিয়েছিলেন জনগণকে।আর একারণেই ১৬ জুলাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস হলেও শেখ হাসিনার জন্য দিনটি অবিনাশী সাহস আর প্রত্যয়ে অভিষিক্ত। তবে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য ভয়ঙ্কর একটি চ্যালেঞ্জের দিনও।কারণ সেদিন তাঁকে বিতর্কিত করে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার হীন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল।যদিও সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় এদেশের প্রতিবাদী জনগণ।আর এজন্যই দিনটি স্মরণীয়।
বিজ্ঞাপন
আজ শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপের সপ্তদশ বার্ষিকী।এই দিনটি এদেশের ইতিহাসে ‘গণতন্ত্র অবরুদ্ধ ও হত্যা প্রচেষ্টা দিবস’ হিসেবে বহুল পরিচিত।২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে ধানমন্ডির নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের জন্য সুধাসদনের চতুর্দিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। চুপ করে ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। গ্রেফতারের আগে নেত্রীর নামে একাধিক মামলা দেয়া হয়। বাসা থেকে তাঁকে পুলিশের একটি জিপে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত এলাকায় তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশবাহিনীর দায়িত্বহীনতার কারণে তিনি নাজেহালের শিকার হন। সেদিন সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। সেই সকালে অনেক রাজনৈতিক কর্মী কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। আদালতে শেখ হাসিনার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত কয়েকটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে ওই সব মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
গ্রেফতারের পরই বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, কবিরা কবিতায় সরব হন। প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করানোর দাবি জানান। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে কারাবন্দি শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালের ১১ জুন আট সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কান ও চোখের চিকিৎসা নেন। দেশে ফেরার পর আবার তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।কারাবরণের পর প্রায় ১ বছর বন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা।তবে ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দেয়া মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করলেও, শেখ হাসিনা পরবর্তীতে সেই অভিযোগ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়, সৎ নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়- তাও প্রমাণিত হয়েছে।
আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার সংগ্রামী জীবনে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে দুঃখের কষ্টিপাথরে সহিষ্ণুতার দীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমানিশার দুর্যোগে প্রাণ বাঁচানোর দুঃসহ স্মৃতি; অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম- কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন; শুরু হলো আরেক জীবন। সেই জীবনের স্মৃতি আছে তাঁর রচনায়, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে।
বঙ্গবন্ধুর ৩ হাজার ৫৩ দিন জেল জীবনে কারা-মুক্তি দিবস একাধিক হলেও আমরা ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারিকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে তাঁর জেল জীবনের সমাপ্তি টেনে দিবসটিকে মুক্ত স্বদেশের মুক্তির বারতায় তাঁর নিঃশ্বাস নেবার অন্যতম দিন হিসেবে চিহ্নিত করি। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের বন্দি জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন তাঁর কারা-মুক্তি দিবস। বঙ্গবন্ধু ও ম্যান্ডেলা উভয়েই নিপীড়ক শাসকের কারা প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন বন্দি থেকেও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির চিন্তায় নিবেদিত ছিলেন। অনুরূপভাবে শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসকদের দ্বারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও কারা-যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগ্যবশত। কারণ স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক শাসক থাকার কথা ছিল না, দেশও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ দেশ-বিদেশে টিকে থাকা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা তখনও সক্রিয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের একাধিকবার চেষ্টা চলেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র পর থেকেই যা ২০২২ পর্যন্ত ২১ বার বলে তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয়। এমনকি সাবজেলে থাকার সময় ‘স্লো পয়জনিংয়ে’ তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।