কখনো কখনো মানুষের জীবনে এমন অর্জন যোগ হয়, যা তার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই অর্জন এতটাই বড় হয়, যা পুরো জাতির জন্য সম্মান বয়ে আনে। হ্যাঁ আমি আমাদের সাফজয়ী মেয়েদের কথা বলছি। তাদের সেই অর্জনের কথা বলছি, যা দেশকে সম্মানিত করেছে। একদম তৃণমূল থেকে উঠে আসা সেইসব মেয়ে জীবনের অসংখ্য প্রতিক‚লতা ও দারিদ্রকে জয় করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এবং স্ট্রাইকার ঋতুপর্ণা চাকমা ইউরোপের এমন একটি ক্লাবে খেলার জন্য ডাক পেয়েছেন, যেটি বর্তমানে উত্তর ম্যাসেডোনিয়ান নারী লীগের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। সেটাও বাংলাদেশের জন্য খুব গর্বের। আমরা তাদের স্যালুট জানাই।
আমাদের নারী ফুটবলাররা শিরোপা জয়ের পর জানতে পারলাম মেয়েরা গত দুইমাস বেতন পাননি। কী অমানবিক আচরণ। এমনিতেই নানাধরনের অভাব ও বাধাবিঘ্ন রয়েছে, এর উপর যখন তাদের প্রাপ্য বেতনটাও পান না, তখন বুঝতে হবে এই মানুষগুলোর অবস্থান প্রান্তিক, এরা অবহেলিত। আজকে শিরোপা জয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আদতে তারা সমাজের পিছিয়েপড়া মানুষ।
এই মেয়েরা প্রায় প্রত্যেকেই ফুটবল খেলতে এসে নানাভাবে সামাজিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এইতো সেদিন বাচ্চা হতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেলেন রাজিয়া। বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়ে খেলেছেন সাফ জয়ী রাজিয়া। যে মেয়েগুলো আজকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলছে, এরা প্রায় সবাই এসেছেন গ্রাম থেকে। তাদের অধিকাংশের পরিবারই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এই মেয়েগুলো একবার গ্রামে ফিরে গেলে যেকোন সময়ে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারেন এবং হয়েছেনও।
২০১৭ সালে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে “হ্যাট্রিক কন্যার” খ্যাতি পেয়েছিলেন যে মেয়েটি, টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পদক নিয়েছিলেন যে মেয়েটি, সেই মেয়েটিও ফুটবল খেলা বাদ দিয়ে সংসার সামলাচ্ছেন। শুধু সে একা নয়, তার বিদ্যালয়ের ৭ জন কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড়ও এখন বল না খেলে, সংসার করছেন। কারণ করোনাকালে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কাজেই আজকের এই তারকারাও যে ঝরে যাবেন না, তা বলা যায় না।
যে মেয়েদের নিয়ে আমরা আজ গর্বিত হচ্ছি, জানিনা এই সমাজ ব্যবস্থায় তারা কিভাবে টিকে থাকবেন? হয়তো ফতোয়ার শিকার হতে হবে, কটূক্তি শুনতে হবে। এর আগেও নারী খেলোয়াড়রা হামলার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এই সমাজ নারীকে চলাফেরা করার, পছন্দ মতো পোশাক পরার, নিজের ইচ্ছামতো জীবন চালনার জন্য কতটা জায়গা করে দেবে, তা ভাবার বিষয়। আর তাই নারীকেই এদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং তা এখুনি। তাইতো কিশোরী ফুটবলার যখন বলেন, ‘অতীতে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক কটূক্তির শিকার হয়েছি। এবার আহত করা হলো। হত্যার হুমকিও দেওয়া হলো। তবে আমি খেলা ছেড়ে দেব না। যতই বাধা আসুক, ফুটবলের সঙ্গে থাকব।’ তারা বলেছেন, সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো, তখন আমরাও যেন তাদের সঙ্গে হাত মেলাই।
যারা খেলছেন তারা যে শুধু সামাজিক বাধা জয় করে এসেছেন, তা নয়, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়েছেন। খেলে যেটুকু টাকা পান, তাই দিয়ে সংসার চালিয়ে নেন। এরা প্রায় সবাই গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবার থেকে এসেছেন। আদিবাসী পরিবার থেকে এসেছেন আরো বেশি। গারো, চাকমা সমাজ নারী প্রধান পরিবার বলে হয়তো নারীরা বের হয়ে আসতে পেরেছেন।
অথচ শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে এখানে প্রতিনিধিত্ব করে না। কেন করে না, জানিনা। হয়তো উৎসাহবোধ করে না, হয়তো পরিবার মনেকরে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। অথবা এই খেলা কষ্টকর ও পরিশ্রমের। ছেলেরা দেশের বিভিন্ন এলাকা ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে খেলতে এলেও মেয়েরা আসছে না। এই বিষয়টা নিয়ে ভাবা দরকার। আরো অনেক মেয়ে ক্রিকেটার ও ফুটবলার তৈরির জন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার। যাদের দিয়ে কোনো কিছু অর্জন সম্ভব, তাদের টেনে তুলতে হবেই।
যে মেয়েরা ক্রিকেট/ফুটবল খেলছেন, তারা এই সমাজের অন্যায্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। শুধু প্রতিপক্ষের বিপক্ষে না, পাশাপাশি এই সমাজব্যবস্থার বিপক্ষেও। নারীবিদ্বেষী এই সমাজ বাধ্য হয়েছে নারীকে সম্মান জানাতে। এদের হাত ধরেই বাংলাদেশে আরো অনেক শিরোপা আসবে নিঃসন্দেহে, শুধু ওদের জন্য সুবিধাটুকু নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। ছেলেদের মতো সমর্থন, সহযোগিতা ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে পেশাগতভাবে।
আমাদের মেয়েরা ক্রিকেটে ২০১৮ সালে ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে তিনটি টুর্নামেন্ট জিতেছে তারা। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন মনিকা চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হয়েছেন জয়া চাকমা। খেলোয়াড় মেয়েদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে এমন সহযোগিতা দিতে হবে, যাতে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান হয়।
বাংলাদেশের মেয়েদের অনেকেই বিয়ের পর পড়ার সুযোগ পান না, চাকরিও করতে পারেন না। সাংসারিক ও সামাজিক বাধা তাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। সেখানে মাঠে খেলার সুযোগ পাওয়ারতো প্রশ্নই আসে না। ১৬ থেকে ২৩ বছর পর্যন্ত মেয়েরা যদি খেলতে চায়, তবে সে বিয়ে করতে পারবে না। আবার এই বয়সে বিয়ে করলে খেলতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুরবাড়ির লোকজন, এমনকি স্বামীও চাইবে না ঘরের বউ মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করুক।
তাছাড়া ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, প্র্যাকটিস কোনোটাই পাওয়া সম্ভব হবে না। কাজেই যা অর্জন করার, তা বিয়ের আগেই অর্জন করার সুযোগ পেতে পারেন আমাদের খেলোয়াড় মেয়েরা। যেহেতু ফুটবল, ক্রিকেটসহ কোনো খেলাই নারীদের জন্য পেশা হিসেবে গড়ে ওঠেনি, তাই মেয়েরা সমাজ সংসার বাদ দিয়ে যে খেলাকে আশ্রয় করে যে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তাও হচ্ছে না। নারী খেলোয়াড়রা ছাদ খোলা বাসে চেপে শহরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন, তা অনন্য। আমাদের দেশের পুরুষ খেলোয়াড়রা যখন জয়ী হয়ে ফেরেন, তখন সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কারের বন্যা বয়ে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে তা দেখছি না। নারীদের পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে উঠে আসার মতো অবকাঠামোই বাংলাদেশে নেই।
তাই নারী খেলোয়াড়দের জন্য বাড়তি কিছু সাপোর্ট লাগবেই এই ঝরেপড়া ঠেকানোর জন্য। সারাদেশ থেকেই কি নারী খেলোয়াড় ট্যালেন্ট হান্ট করা হয়? তাদের গড়ে তোলার জন্য জেলা উপজেলা পর্যায়ে যে ব্যবস্থা থাকা দরকার সেটা কি তৈরি হয়েছে? তাদের আর্থিক নিশ্চয়তাই বা কোথায়? আরো মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে এই পথে নিয়ে আসতে হবে। ওদের জন্য ভাল প্রশিক্ষণ, মাথাগোঁজার ঠাই, প্রতিদিনের সুষম খাবার, খেলার সরঞ্জাম পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা আশা করতেই পারি এইবার মেয়েদের খেলার বিষয়টি নিয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অন্যভাবে ভাববে। তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয়া হোক। বিজয় উদযাপনের মাধ্যমে যেন মেয়েগুলোর আসল দাবি অর্থাৎ তাদের অবস্থা পরিবর্তনের দাবি যেন আমরা ভুলে না যাই। মেয়েগুলোর প্রাপ্য সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিটা যেন বজায় থাকে। মেয়েরা তাদের সেরাটা দিয়েছেন, আমাদেরও উচিৎ তাদেরকে সেরা কিছু দেয়া। দেশের জন্য যারা সম্মান বয়ে এনেছেন, আমাদেরও উচিৎ তাদের যথাযথ সম্মান দেয়া। শুধু সরকারের কাছে অনুরোধ মেয়েগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কতধরনের উন্নয়ন প্রকল্প হতে নেয়া হয়, এবারে মানব উন্নয়নের জন্য মাঠ থেকে উঠে আসা এই মেয়েগুলোকে সহায়তা দিন। জয়ীদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি, বিভিন্ন গোষ্ঠীর জুলুমের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। মেয়েরা আমরা তোমাদের জন্য কিছুই করিনি, কিন্তু তোমরা তোমাদের শ্রেষ্ঠটা দেশকে দিয়েছো। তোমাদের সালাম।
আমাদের নারী ফুটবলাররা শিরোপা জয়ের পর জানতে পারলাম মেয়েরা গত দুইমাস বেতন পাননি। কী অমানবিক আচরণ। এমনিতেই নানাধরনের অভাব ও বাধাবিঘ্ন রয়েছে, এর উপর যখন তাদের প্রাপ্য বেতনটাও পান না, তখন বুঝতে হবে এই মানুষগুলোর অবস্থান প্রান্তিক, এরা অবহেলিত। আজকে শিরোপা জয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আদতে তারা সমাজের পিছিয়েপড়া মানুষ।
এই মেয়েরা প্রায় প্রত্যেকেই ফুটবল খেলতে এসে নানাভাবে সামাজিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এইতো সেদিন বাচ্চা হতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেলেন রাজিয়া। বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়ে খেলেছেন সাফ জয়ী রাজিয়া। যে মেয়েগুলো আজকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলছে, এরা প্রায় সবাই এসেছেন গ্রাম থেকে। তাদের অধিকাংশের পরিবারই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এই মেয়েগুলো একবার গ্রামে ফিরে গেলে যেকোন সময়ে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারেন এবং হয়েছেনও।
২০১৭ সালে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে “হ্যাট্রিক কন্যার” খ্যাতি পেয়েছিলেন যে মেয়েটি, টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পদক নিয়েছিলেন যে মেয়েটি, সেই মেয়েটিও ফুটবল খেলা বাদ দিয়ে সংসার সামলাচ্ছেন। শুধু সে একা নয়, তার বিদ্যালয়ের ৭ জন কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড়ও এখন বল না খেলে, সংসার করছেন। কারণ করোনাকালে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কাজেই আজকের এই তারকারাও যে ঝরে যাবেন না, তা বলা যায় না।
যে মেয়েদের নিয়ে আমরা আজ গর্বিত হচ্ছি, জানিনা এই সমাজ ব্যবস্থায় তারা কিভাবে টিকে থাকবেন? হয়তো ফতোয়ার শিকার হতে হবে, কটূক্তি শুনতে হবে। এর আগেও নারী খেলোয়াড়রা হামলার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এই সমাজ নারীকে চলাফেরা করার, পছন্দ মতো পোশাক পরার, নিজের ইচ্ছামতো জীবন চালনার জন্য কতটা জায়গা করে দেবে, তা ভাবার বিষয়। আর তাই নারীকেই এদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং তা এখুনি। তাইতো কিশোরী ফুটবলার যখন বলেন, ‘অতীতে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক কটূক্তির শিকার হয়েছি। এবার আহত করা হলো। হত্যার হুমকিও দেওয়া হলো। তবে আমি খেলা ছেড়ে দেব না। যতই বাধা আসুক, ফুটবলের সঙ্গে থাকব।’ তারা বলেছেন, সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো, তখন আমরাও যেন তাদের সঙ্গে হাত মেলাই।
যারা খেলছেন তারা যে শুধু সামাজিক বাধা জয় করে এসেছেন, তা নয়, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়েছেন। খেলে যেটুকু টাকা পান, তাই দিয়ে সংসার চালিয়ে নেন। এরা প্রায় সবাই গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবার থেকে এসেছেন। আদিবাসী পরিবার থেকে এসেছেন আরো বেশি। গারো, চাকমা সমাজ নারী প্রধান পরিবার বলে হয়তো নারীরা বের হয়ে আসতে পেরেছেন।
অথচ শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে এখানে প্রতিনিধিত্ব করে না। কেন করে না, জানিনা। হয়তো উৎসাহবোধ করে না, হয়তো পরিবার মনেকরে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। অথবা এই খেলা কষ্টকর ও পরিশ্রমের। ছেলেরা দেশের বিভিন্ন এলাকা ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে খেলতে এলেও মেয়েরা আসছে না। এই বিষয়টা নিয়ে ভাবা দরকার। আরো অনেক মেয়ে ক্রিকেটার ও ফুটবলার তৈরির জন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার। যাদের দিয়ে কোনো কিছু অর্জন সম্ভব, তাদের টেনে তুলতে হবেই।
যে মেয়েরা ক্রিকেট/ফুটবল খেলছেন, তারা এই সমাজের অন্যায্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। শুধু প্রতিপক্ষের বিপক্ষে না, পাশাপাশি এই সমাজব্যবস্থার বিপক্ষেও। নারীবিদ্বেষী এই সমাজ বাধ্য হয়েছে নারীকে সম্মান জানাতে। এদের হাত ধরেই বাংলাদেশে আরো অনেক শিরোপা আসবে নিঃসন্দেহে, শুধু ওদের জন্য সুবিধাটুকু নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। ছেলেদের মতো সমর্থন, সহযোগিতা ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে পেশাগতভাবে।
আমাদের মেয়েরা ক্রিকেটে ২০১৮ সালে ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে তিনটি টুর্নামেন্ট জিতেছে তারা। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন মনিকা চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হয়েছেন জয়া চাকমা। খেলোয়াড় মেয়েদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে এমন সহযোগিতা দিতে হবে, যাতে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান হয়।
বাংলাদেশের মেয়েদের অনেকেই বিয়ের পর পড়ার সুযোগ পান না, চাকরিও করতে পারেন না। সাংসারিক ও সামাজিক বাধা তাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। সেখানে মাঠে খেলার সুযোগ পাওয়ারতো প্রশ্নই আসে না। ১৬ থেকে ২৩ বছর পর্যন্ত মেয়েরা যদি খেলতে চায়, তবে সে বিয়ে করতে পারবে না। আবার এই বয়সে বিয়ে করলে খেলতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুরবাড়ির লোকজন, এমনকি স্বামীও চাইবে না ঘরের বউ মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করুক।
তাছাড়া ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, প্র্যাকটিস কোনোটাই পাওয়া সম্ভব হবে না। কাজেই যা অর্জন করার, তা বিয়ের আগেই অর্জন করার সুযোগ পেতে পারেন আমাদের খেলোয়াড় মেয়েরা। যেহেতু ফুটবল, ক্রিকেটসহ কোনো খেলাই নারীদের জন্য পেশা হিসেবে গড়ে ওঠেনি, তাই মেয়েরা সমাজ সংসার বাদ দিয়ে যে খেলাকে আশ্রয় করে যে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তাও হচ্ছে না। নারী খেলোয়াড়রা ছাদ খোলা বাসে চেপে শহরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন, তা অনন্য। আমাদের দেশের পুরুষ খেলোয়াড়রা যখন জয়ী হয়ে ফেরেন, তখন সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কারের বন্যা বয়ে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে তা দেখছি না। নারীদের পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে উঠে আসার মতো অবকাঠামোই বাংলাদেশে নেই।
তাই নারী খেলোয়াড়দের জন্য বাড়তি কিছু সাপোর্ট লাগবেই এই ঝরেপড়া ঠেকানোর জন্য। সারাদেশ থেকেই কি নারী খেলোয়াড় ট্যালেন্ট হান্ট করা হয়? তাদের গড়ে তোলার জন্য জেলা উপজেলা পর্যায়ে যে ব্যবস্থা থাকা দরকার সেটা কি তৈরি হয়েছে? তাদের আর্থিক নিশ্চয়তাই বা কোথায়? আরো মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে এই পথে নিয়ে আসতে হবে। ওদের জন্য ভাল প্রশিক্ষণ, মাথাগোঁজার ঠাই, প্রতিদিনের সুষম খাবার, খেলার সরঞ্জাম পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা আশা করতেই পারি এইবার মেয়েদের খেলার বিষয়টি নিয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অন্যভাবে ভাববে। তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয়া হোক। বিজয় উদযাপনের মাধ্যমে যেন মেয়েগুলোর আসল দাবি অর্থাৎ তাদের অবস্থা পরিবর্তনের দাবি যেন আমরা ভুলে না যাই। মেয়েগুলোর প্রাপ্য সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিটা যেন বজায় থাকে। মেয়েরা তাদের সেরাটা দিয়েছেন, আমাদেরও উচিৎ তাদেরকে সেরা কিছু দেয়া। দেশের জন্য যারা সম্মান বয়ে এনেছেন, আমাদেরও উচিৎ তাদের যথাযথ সম্মান দেয়া। শুধু সরকারের কাছে অনুরোধ মেয়েগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কতধরনের উন্নয়ন প্রকল্প হতে নেয়া হয়, এবারে মানব উন্নয়নের জন্য মাঠ থেকে উঠে আসা এই মেয়েগুলোকে সহায়তা দিন। জয়ীদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি, বিভিন্ন গোষ্ঠীর জুলুমের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। মেয়েরা আমরা তোমাদের জন্য কিছুই করিনি, কিন্তু তোমরা তোমাদের শ্রেষ্ঠটা দেশকে দিয়েছো। তোমাদের সালাম।