প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’
সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত এই বাক্যটি পড়ে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু খেয়াল করা দরকার, এখানে বলা হয়েছে ‘জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ’ হবে। জনগণের পক্ষে কে বা কারা ক্ষমতার প্রয়োগ করেন? প্রথমত জনপ্রতিনিধিরা, দ্বিতীয়ত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এখন প্রশ্ন হলো, সেই জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিতরা কি আদৌ এটা বিশ্বাস করেন যে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক? সম্পূরক প্রশ্ন হলো, জনগণ তার সংবিধান প্রদত্ত মালিকানা কীভাবে এবং কোথায় প্রয়োগ করে? আর যদি জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণকে তার ক্ষমতারা মালিকানা প্রয়োগে বাধা দেয় বা জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়— তাহলে কী হবে? জনগণ কি তার পক্ষে সংবিধানের ক্ষমতা প্রয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বা সরিয়ে দিতে পারে?
৮ম সংশোধনী মামলার (আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ) রায়ে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের ‘পোল স্টার’ বলা হয়েছে। এই মামলার রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, সংসদ এই সংবিধানের প্রণেতা এবং সমস্ত ক্ষমতা ৭ অনুচ্ছেদ থেকে নিঃসৃত এবং পার্লামেন্ট এই অনুচ্ছেদকে সংশোধন করা পারে না। (এএসএম মাহমুদুল হক, বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা, সুফি প্রকাশনী/২০১০, পৃ. ১৫)।
বাংলাদেশের সংবিধানের আরও একাধিক অনুচ্ছেদে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো জটিলতা রয়ে গেছে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার জনগণের ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা কখনো কখনো এই ক্ষমতায়নকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে নির্বাচনে অনিয়ম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানবাধিকার হরণের ঘটনাগুলো জনগণের ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ করে। উপরন্তু জনগণকেই জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ‘অধীনস্ত’ করে দেয়।
জনগণের প্রতিনিধিরা সংসদে যে আইন ও বিধি-বিধান পাস করেন, তার আলোকেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার মানে পরোক্ষভাবে তারাও জনগণের দ্বারাই নিয়োগপ্রাপ্ত। যে কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তথা জনগণের সেবক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বাস্তবতা ভিন্ন। যেমন সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ কিন্তু সরকারি অফিসগুলোয় সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাতে এটি বলার সুযোগ নেই যে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। বরং ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করার’ যে নির্দেশনা সংবিধান দিয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তা থেকে ঢের দূরে অবস্থান করেন। বেতনের বাইরেও নির্দিষ্ট কাজের জন্য ঘুষ, সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি নিত্যদিনের চিত্র। অর্থাৎ সংবিধান জনগণকে যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক বলে ঘোষণা করেছে, সরকারি অফিসগুলোয় তার কোনো প্রতিফলন নেই।
সংবিধান জনগণের ক্ষমতায়নের কাঠামো তৈরি করলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির ওপর। জনগণের অধিকার ও ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং প্রশাসনের স্বাধীনতা ও জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই।
তাহলে জনগণ কীভাবে তার ক্ষমতার মালিকানা প্রয়োগ করবে? সহজ উত্তর নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের শাসনভার কাদের ওপর অর্পিত হবে, জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সেটি নির্ধারণ করবে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবেন। কিন্তু বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ কি ভোট দিতে পেরেছে বা জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনেও যেভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গণহারে প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটি যে প্রশ্নবিদ্ধ হলো, তা কি সংবিধানপ্রদত্ত জনগণের ক্ষমতার মালিকানা প্রয়োগের অন্তরায় নয়?
জনগণ যদি ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারে; ভোটার যদি কেন্দ্রে গিয়ে শোনে যে তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে; যদি কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি, চেয়ারম্যান, মেয়র হয়ে যাওয়া যায়— তাহলে জনগণের ভোটের কী মূল্য থাকে?
জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে যদি জনগণের ভোটই না লাগে, তাহলে সেখানে জনগণের ক্ষমতার মালিকানা প্রয়োগ হলো কোথায়? তার মানে রাষ্ট্র যখন নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দেয় তথা জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জনগণকেই উপেক্ষা করে— সেখানে স্পষ্টতই সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়।
এর সমাধান কী? সমাধান হলো-
১. বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান বাতিল করতে হবে। অর্থাৎ যদি কোনো সংসদীয় আসন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী না থাকেন তাহলে সেখানে পুনরায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন মানে যে প্রত্যক্ষ ভোট, সেটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে জনগণ ভোট দিয়েই তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে।
২. নির্বাচনী ব্যবস্থাটি হতে হবে স্বচ্ছ, দলীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হলেই তিনি বাড়তি সুবিধা পাবেন—এই অলিখিত নিয়মের অবসান ঘটাতে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৩. সরকার ও দল একাকার করে ফেলার মধ্য দিয়ে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছে, সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। এই তিনটি পদে তিনজন আলাদা ব্যক্তি থাকবেন। এটি নিশ্চিত করা গেলে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনু্ষ্ঠান সম্ভব হবে এবং তার মধ্য দিয়ে জনগণের ক্ষমতার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।
৪. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জনপ্রতিনিধিদের ‘রিকল’ বা প্রত্যাহার পদ্ধতি আছে। অর্থাৎ এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জনগণ তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দিতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় জনগণের হাতে এমন ক্ষমতা থাকে যাতে তারা নিজেদের প্রতিনিধি যদি অসৎ, অদক্ষ বা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেন, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচন অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এটি বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। যেমন:
ক. পিটিশন বা আবেদন। প্রথম ধাপে জনগণকে একটি আবেদন বা পিটিশন তৈরি করতে হয়, যাতে জনপ্রতিনিধিকে সরানোর পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন থাকে। নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারকে এই পিটিশনে স্বাক্ষর করতে হয়।
খ. যাচাই-বাছাই। পিটিশনের স্বাক্ষর এবং এর যথার্থতা যাচাই করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এটি বোঝানো হয় যে, সত্যিকার অর্থেই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি জনগণের আস্থা হারিয়েছেন।
গ. ভোটাভুটি। যদি পিটিশন যথেষ্ট সমর্থন পায়, তবে রিকল বা ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এই ভোটে জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা জনপ্রতিনিধিকে পদে রাখতে চান না কি সরিয়ে দিতে চান।
ঘ. ফলাফল কার্যকরী করা। ভোটাভুটির ফলাফলে যদি জনপ্রতিনিধিকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়, তবে তাকে পদত্যাগ করতে হয় এবং তার পদটি শূন্য ঘোষিত হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধানে সরাসরি রিকল পদ্ধতি নেই। কিন্তু জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে এই পদ্ধতি নিয়ে এখন কথা বলা উচিত। সংবিধান সংস্কারে খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন। কমিশনের সদস্যরা গত শনিবার বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। এ সময় ড. কামাল হোসেনও তাদেরকে সংবিধানটি সমসাময়িক করার পরামর্শ দিয়েছেন। (ডেইলি স্টার বাংলা, ০২ নভেম্বর ২০২৪)।
পরিশেষে, সংবিধান জনগণের ক্ষমতায়নের কাঠামো তৈরি করলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির ওপর। জনগণের অধিকার ও ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং প্রশাসনের স্বাধীনতা ও জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।
সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত এই বাক্যটি পড়ে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু খেয়াল করা দরকার, এখানে বলা হয়েছে ‘জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ’ হবে। জনগণের পক্ষে কে বা কারা ক্ষমতার প্রয়োগ করেন? প্রথমত জনপ্রতিনিধিরা, দ্বিতীয়ত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এখন প্রশ্ন হলো, সেই জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিতরা কি আদৌ এটা বিশ্বাস করেন যে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক? সম্পূরক প্রশ্ন হলো, জনগণ তার সংবিধান প্রদত্ত মালিকানা কীভাবে এবং কোথায় প্রয়োগ করে? আর যদি জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণকে তার ক্ষমতারা মালিকানা প্রয়োগে বাধা দেয় বা জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়— তাহলে কী হবে? জনগণ কি তার পক্ষে সংবিধানের ক্ষমতা প্রয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বা সরিয়ে দিতে পারে?
৮ম সংশোধনী মামলার (আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ) রায়ে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের ‘পোল স্টার’ বলা হয়েছে। এই মামলার রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, সংসদ এই সংবিধানের প্রণেতা এবং সমস্ত ক্ষমতা ৭ অনুচ্ছেদ থেকে নিঃসৃত এবং পার্লামেন্ট এই অনুচ্ছেদকে সংশোধন করা পারে না। (এএসএম মাহমুদুল হক, বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা, সুফি প্রকাশনী/২০১০, পৃ. ১৫)।
বাংলাদেশের সংবিধানের আরও একাধিক অনুচ্ছেদে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো জটিলতা রয়ে গেছে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার জনগণের ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা কখনো কখনো এই ক্ষমতায়নকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে নির্বাচনে অনিয়ম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানবাধিকার হরণের ঘটনাগুলো জনগণের ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ করে। উপরন্তু জনগণকেই জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ‘অধীনস্ত’ করে দেয়।
জনগণের প্রতিনিধিরা সংসদে যে আইন ও বিধি-বিধান পাস করেন, তার আলোকেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার মানে পরোক্ষভাবে তারাও জনগণের দ্বারাই নিয়োগপ্রাপ্ত। যে কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তথা জনগণের সেবক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বাস্তবতা ভিন্ন। যেমন সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ কিন্তু সরকারি অফিসগুলোয় সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাতে এটি বলার সুযোগ নেই যে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। বরং ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করার’ যে নির্দেশনা সংবিধান দিয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তা থেকে ঢের দূরে অবস্থান করেন। বেতনের বাইরেও নির্দিষ্ট কাজের জন্য ঘুষ, সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি নিত্যদিনের চিত্র। অর্থাৎ সংবিধান জনগণকে যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক বলে ঘোষণা করেছে, সরকারি অফিসগুলোয় তার কোনো প্রতিফলন নেই।
সংবিধান জনগণের ক্ষমতায়নের কাঠামো তৈরি করলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির ওপর। জনগণের অধিকার ও ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং প্রশাসনের স্বাধীনতা ও জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই।
তাহলে জনগণ কীভাবে তার ক্ষমতার মালিকানা প্রয়োগ করবে? সহজ উত্তর নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের শাসনভার কাদের ওপর অর্পিত হবে, জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সেটি নির্ধারণ করবে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবেন। কিন্তু বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ কি ভোট দিতে পেরেছে বা জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনেও যেভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গণহারে প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটি যে প্রশ্নবিদ্ধ হলো, তা কি সংবিধানপ্রদত্ত জনগণের ক্ষমতার মালিকানা প্রয়োগের অন্তরায় নয়?
জনগণ যদি ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারে; ভোটার যদি কেন্দ্রে গিয়ে শোনে যে তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে; যদি কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি, চেয়ারম্যান, মেয়র হয়ে যাওয়া যায়— তাহলে জনগণের ভোটের কী মূল্য থাকে?
জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে যদি জনগণের ভোটই না লাগে, তাহলে সেখানে জনগণের ক্ষমতার মালিকানা প্রয়োগ হলো কোথায়? তার মানে রাষ্ট্র যখন নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দেয় তথা জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জনগণকেই উপেক্ষা করে— সেখানে স্পষ্টতই সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়।
এর সমাধান কী? সমাধান হলো-
১. বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান বাতিল করতে হবে। অর্থাৎ যদি কোনো সংসদীয় আসন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী না থাকেন তাহলে সেখানে পুনরায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন মানে যে প্রত্যক্ষ ভোট, সেটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে জনগণ ভোট দিয়েই তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে।
২. নির্বাচনী ব্যবস্থাটি হতে হবে স্বচ্ছ, দলীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হলেই তিনি বাড়তি সুবিধা পাবেন—এই অলিখিত নিয়মের অবসান ঘটাতে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৩. সরকার ও দল একাকার করে ফেলার মধ্য দিয়ে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছে, সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। এই তিনটি পদে তিনজন আলাদা ব্যক্তি থাকবেন। এটি নিশ্চিত করা গেলে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনু্ষ্ঠান সম্ভব হবে এবং তার মধ্য দিয়ে জনগণের ক্ষমতার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।
৪. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জনপ্রতিনিধিদের ‘রিকল’ বা প্রত্যাহার পদ্ধতি আছে। অর্থাৎ এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জনগণ তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দিতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় জনগণের হাতে এমন ক্ষমতা থাকে যাতে তারা নিজেদের প্রতিনিধি যদি অসৎ, অদক্ষ বা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেন, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচন অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এটি বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। যেমন:
ক. পিটিশন বা আবেদন। প্রথম ধাপে জনগণকে একটি আবেদন বা পিটিশন তৈরি করতে হয়, যাতে জনপ্রতিনিধিকে সরানোর পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন থাকে। নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারকে এই পিটিশনে স্বাক্ষর করতে হয়।
খ. যাচাই-বাছাই। পিটিশনের স্বাক্ষর এবং এর যথার্থতা যাচাই করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এটি বোঝানো হয় যে, সত্যিকার অর্থেই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি জনগণের আস্থা হারিয়েছেন।
গ. ভোটাভুটি। যদি পিটিশন যথেষ্ট সমর্থন পায়, তবে রিকল বা ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এই ভোটে জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা জনপ্রতিনিধিকে পদে রাখতে চান না কি সরিয়ে দিতে চান।
ঘ. ফলাফল কার্যকরী করা। ভোটাভুটির ফলাফলে যদি জনপ্রতিনিধিকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়, তবে তাকে পদত্যাগ করতে হয় এবং তার পদটি শূন্য ঘোষিত হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধানে সরাসরি রিকল পদ্ধতি নেই। কিন্তু জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে এই পদ্ধতি নিয়ে এখন কথা বলা উচিত। সংবিধান সংস্কারে খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন। কমিশনের সদস্যরা গত শনিবার বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। এ সময় ড. কামাল হোসেনও তাদেরকে সংবিধানটি সমসাময়িক করার পরামর্শ দিয়েছেন। (ডেইলি স্টার বাংলা, ০২ নভেম্বর ২০২৪)।
পরিশেষে, সংবিধান জনগণের ক্ষমতায়নের কাঠামো তৈরি করলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির ওপর। জনগণের অধিকার ও ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং প্রশাসনের স্বাধীনতা ও জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।