যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে লড়াই জমে উঠছে। ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে জরিপের ফলাফল। কিছুদিন আগেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস প্রায় প্রতিটি জরিপে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকলেও শেষ পর্যায়ে এসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্য পঞ্চাশটা। এ পঞ্চাশটা রাজ্যের ভেতরে এমন কতগুলো স্টেট বা রাজ্য আছে যেগুলোকে রিপাবলিকান রেড স্টেটস বা রিপাবলিকানদের ঘাটি বলা হয়। এখানে ট্রাম্প প্রচারণা না চালালেও খুব সহজেই জিতে যাবেন। অপরদিকে কিছু রাজ্য আছে যেগুলোকে ডেমোক্রেটিক ব্লু স্টেটস বলা হয়। নিশ্চিতভাবেই সেখানে কমলা হ্যারিস জয়লাভ করবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টা অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। এর ভেতরে যে প্রার্থী ২৭০ বা তার বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পান, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে যেই নির্বাচিত হোন না কেন, ৭টি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেটের এই ৯৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটই নির্ধারণ করবে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতু্ন প্রেসিডে্ন্ট।
এসবের পাশাপাশি নীল ও লালের কিছু স্টেটস বা রাজ্য আছে, যারা কখনো ডেমোক্র্যাটদের কখনো রিপাবলিকানদের নির্বাচিত করে। এগুলোকে বলা হয় দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেট। এরাই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। এরকম রাজ্যের সংখ্যা সাতটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের জন্য শুধু এই সাতটা রণক্ষেত্রের জনমতের হিসেবে নিলেই হবে। নির্বাচনের ফল কার দিকে যাবে তা নির্ভর করছে মূলত ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ হিসেবে পরিচিত কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের ওপর।
এসব রাজ্যের মধ্যে আছে— পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, অ্যারিজোনা, নেভাদা, মিশিগান এবং উইসকনসিন। যেহেতু শুধু নীল বা লালের অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর ইলেটোরাল ভোট দিয়ে কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না, ফলে এই দোদুল্যমান রাজ্যগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হার-জিতের নির্ধারক হয়ে উঠবে।
এই সুইং স্টেটগুলোর মধ্যে অন্যতম ১৫টি ইলেকটোরাল কলেজের রাজ্য মিশিগানে ১৯৯২ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হওয়া সাতটি নির্বাচনের মধ্যে ছয়বারই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জয়লাভ করে। ২০২০ সালের নির্বাচনেও বাইডেন এখানে জয়লাভ করেছিলেন। তবে ভোটের ব্যবধান বেশি ছিল না। ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী ০.৩ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। ফলে দুশ্চিন্তা বাড়ছে ডেমোক্র্যাট শিবিরে।
এখানে ডেমোক্র্যাটদের চিন্তার কারণ হচ্ছেন এখানকার মুসলিম এবং আরব-আমেরিকান ভোটাররা। জনসংখ্যার অনুপাতে মিশিগানে আরব-আমেরিকান বংশোদ্ভূত ভোটারদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গাজা এবং লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণ বন্ধ করতে বাইডেন প্রশাসনের নীরবতা রাজ্যটির ৩ লাখ আরব-আমেরিকান ভোটারকে গভীরভাবে আঘাত করেছে। আর এর জন্য বাইডেনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হ্যারিসকেও সমানভাবে দায়ী করছেন তারা। ক্ষুব্ধ এই অংশটি যারা এর আগের নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ভোট দিতেন তারা এবার কমলার পরিবর্তে গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইন কিংবা ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারে। ফলে জরিপে আপাতত এগিয়ে থাকলেও মিশিগানে স্বস্তিতে নেই কমলা।
যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে আরেক ব্যাটল গ্রাউন্ড অ্যারিজোনার অবস্থান। এই রাজ্যের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ আফ্রিকান-আমেরিকান, সমসংখ্যক রেড ইন্ডিয়ান। এছাড়া হিস্পানিক মানুষ আছে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। যে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প সবসময় উচ্চকণ্ঠ, সেই অভিবাসীদের বড় অংশটি এই রাজ্যেই। বলা হচ্ছে, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গেম চেঞ্জার হতে পারে এই অ্যারিজোনা। ১১টি ইলেকটোরাল ভোট থাকা এই রাজ্য প্রথাগতভাবে রিপাবলিক পার্টির ঘাঁটি হলেও ১৯৯৬ সালে বিল ক্লিনটন এবং ২০২০ সালে জো বাইডেনের পক্ষে রায় দিয়েছিল। তবে এ বছর অ্যারিজোনার পুরোনো শিবিরে ফেরার পূর্বাভাস মিলেছে।
মেরিস্ট কলেজ, ইউএসএ টুডে ও সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ জরিপ বলছে, অ্যারিজোনায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের চেয়ে ১ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে, ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের সর্বশেষ জরিপের তথ্য বলছে, অ্যারিজোনায় ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। কমলা হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসাবে ২ দশমিক ১ শতাংশ সমর্থনে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। এই রাজ্যে ভোটাররা সীমান্ত নিয়ে প্রার্থীদের অবস্থান দেখে ভোট দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা মেক্সিকোর সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে রাজ্যটির। এখানে প্রচারে অভিবাসন বিরোধী নীতিকে শক্তভাবে কাজে লাগাতে চাইছেন ট্রাম্প।
১০ ইলেকটোরাল ভোটের আরেক দোদুল্যমান রাজ্য উইসকনসিনে গত ছয় নির্বাচনের পাঁচটিতে জয়লাভ করেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীরা। তবে যে একটিতে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন, সেই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ রাজ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টি ভালো করলেও প্রতিবারই জিতেছে খুবই সামান্য ব্যবধানে। এবারের রিপাবলিকান পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশন হয়েছে এই রাজ্যে, ট্রাম্প দলীয় নমিনেশনও নিয়েছেন এখান থেকেই। রাজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ শ্বেতাঙ্গ। ফলে উইসকনসিনের ১০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটকে টার্গেট করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ওয়াশিংটন পোস্ট-শচার স্কুল পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে এখানে এগিয়ে কমালা হ্যারিস। তাকে সমর্থন করেছেন শতকরা ৫০ ভাগ ভোটার আর ট্রাম্পকে ৪৭ ভাগ ভোটার। তবে ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের জরিপ অনুসারে,কমলা হ্যারিস এই রাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় অক্টোবরের শুরুতেও ২ শতাংশের বেশি ব্যবধানে থাকলেও বর্তমানে সেই ব্যবধান মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্যের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল কলেজ পেনসিলভানিয়ায়— ১৯টি। এবার সেখানে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন ইহুদি ভোটাররা। অধিকাংশ মার্কিন ইহুদি ভোটার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকলেও গাজা যুদ্ধের কারণে এবার তেমনটি হবে না বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশটিতে মুসলিমবিদ্বেষের মতো ইহুদিবিদ্বেষও সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের মতো ইহুদি হলেও পেনসিলভানিয়ার মোট জনসংখ্যার ৩.৩ শতাংশ ইহুদি। ট্রাম্প এবং তার দলের কর্মীরা স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনবিরোধী হলেও কমলা ফিলিস্তিনিদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল।
তাছাড়া, রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে পেনসিলভানিয়াতে। যে ঘটনা পরিণত হয় অন্যতম নির্বাচনী ইস্যুতে। ১৯টি ইলেকটোরাল কলেজের এই রাজ্য সর্বশেষ দুই নির্বাচনেই নিয়েছে বিজয়ীর পক্ষ। এবারও বিজয়ী নির্ধারণে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এবিসি নিউজের জরিপে ১ পয়েন্ট এবং ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের জরিপে শূন্য দশমিক চার শতাংশ ব্যবধানে এখানে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প। অন্যদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট-শচার স্কুল পরিচালিত জরিপে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা।
৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্য নেভাদার গভর্নর একজন রিপাবলিকান। দুই সিনেটর আবার ডেমোক্রেটিক পার্টির। ভোটারদের মধ্যে দুই দলের সমর্থক প্রায় সমান। সর্বশেষ নির্বাচনে ট্রাম্পকে মাত্র ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন বাইডেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-শচার স্কুল পরিচালিত জরিপে এখানে দুই প্রার্থীই সমান সমর্থন পেয়েছেন।
১৬ ইলেকটোরাল কলেজের গুরুত্বপূর্ণ আরেক ব্যাটল গ্রাউন্ড নর্থ ক্যারোলাইনা প্রথাগতভাবে রিপাবলিকানদের ঘাটি বলেই বিবেচিত। সর্বশেষ নির্বাচনেও এখানে জিতেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে গত কয়েকটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এখানে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে ব্যবধান কমছে ডেমোক্রেটিক পার্টির। তাছাড়া, এ রাজ্যে ২২ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকানের পাশাপাশি ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে হিস্পানিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।
তদুপরি, মোট ভোটারের ৫১ শতাংশই নারী। এসব ইকুয়েশনের কারণে এটি রূপ নিয়েছে সুইং স্টেটে। এ রাজ্যে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা বারবার পরাজিত হলেও এসব সমীকরণই এবার আশা দেখাচ্ছে তাদের। মেরিস্ট কলেজের সর্বশেষ জরিপে এখানে ২ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প।
১৬টি ইলেকটোরাল কলেজের দোদুল্যমান রাজ্য জর্জিয়ায় ১৯৯২ সালের পর জো বাইডেনই প্রথম ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে গত নির্বাচনে জয়লাভ করেন। যদিও ব্যবধান ছিল খুবই সামান্য। মাত্র ১২ হাজার ভোট। এই রাজ্যের প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোটারই কৃষ্ণাঙ্গ, ফলে আশাবাদী হয়ে উঠছে ডেমোক্র্যাটরা। এখানে আগস্টের শুরু থেকে বেশ কয়েকবার উভয় প্রার্থীর অবস্থান পরিবর্তন হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। মেরিস্ট কলেজের সাম্প্রতিক এক জরিপে ট্রাম্প এবং কমলা উভয়ের জনসমর্থন দেখানো হয়েছে ৪৯ শতাংশ করে। তবে ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের সর্বশেষ জরিপে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন ১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টা অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। এর ভেতরে যে প্রার্থী ২৭০ বা তার বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পান, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে যেই নির্বাচিত হোন না কেন, ৭টি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেটের এই ৯৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটই নির্ধারণ করবে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতু্ন প্রেসিডে্ন্ট।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্য পঞ্চাশটা। এ পঞ্চাশটা রাজ্যের ভেতরে এমন কতগুলো স্টেট বা রাজ্য আছে যেগুলোকে রিপাবলিকান রেড স্টেটস বা রিপাবলিকানদের ঘাটি বলা হয়। এখানে ট্রাম্প প্রচারণা না চালালেও খুব সহজেই জিতে যাবেন। অপরদিকে কিছু রাজ্য আছে যেগুলোকে ডেমোক্রেটিক ব্লু স্টেটস বলা হয়। নিশ্চিতভাবেই সেখানে কমলা হ্যারিস জয়লাভ করবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টা অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। এর ভেতরে যে প্রার্থী ২৭০ বা তার বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পান, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে যেই নির্বাচিত হোন না কেন, ৭টি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেটের এই ৯৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটই নির্ধারণ করবে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতু্ন প্রেসিডে্ন্ট।
এসবের পাশাপাশি নীল ও লালের কিছু স্টেটস বা রাজ্য আছে, যারা কখনো ডেমোক্র্যাটদের কখনো রিপাবলিকানদের নির্বাচিত করে। এগুলোকে বলা হয় দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেট। এরাই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। এরকম রাজ্যের সংখ্যা সাতটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের জন্য শুধু এই সাতটা রণক্ষেত্রের জনমতের হিসেবে নিলেই হবে। নির্বাচনের ফল কার দিকে যাবে তা নির্ভর করছে মূলত ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ হিসেবে পরিচিত কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের ওপর।
এসব রাজ্যের মধ্যে আছে— পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, অ্যারিজোনা, নেভাদা, মিশিগান এবং উইসকনসিন। যেহেতু শুধু নীল বা লালের অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর ইলেটোরাল ভোট দিয়ে কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না, ফলে এই দোদুল্যমান রাজ্যগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হার-জিতের নির্ধারক হয়ে উঠবে।
এই সুইং স্টেটগুলোর মধ্যে অন্যতম ১৫টি ইলেকটোরাল কলেজের রাজ্য মিশিগানে ১৯৯২ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হওয়া সাতটি নির্বাচনের মধ্যে ছয়বারই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জয়লাভ করে। ২০২০ সালের নির্বাচনেও বাইডেন এখানে জয়লাভ করেছিলেন। তবে ভোটের ব্যবধান বেশি ছিল না। ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী ০.৩ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। ফলে দুশ্চিন্তা বাড়ছে ডেমোক্র্যাট শিবিরে।
এখানে ডেমোক্র্যাটদের চিন্তার কারণ হচ্ছেন এখানকার মুসলিম এবং আরব-আমেরিকান ভোটাররা। জনসংখ্যার অনুপাতে মিশিগানে আরব-আমেরিকান বংশোদ্ভূত ভোটারদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গাজা এবং লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণ বন্ধ করতে বাইডেন প্রশাসনের নীরবতা রাজ্যটির ৩ লাখ আরব-আমেরিকান ভোটারকে গভীরভাবে আঘাত করেছে। আর এর জন্য বাইডেনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হ্যারিসকেও সমানভাবে দায়ী করছেন তারা। ক্ষুব্ধ এই অংশটি যারা এর আগের নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ভোট দিতেন তারা এবার কমলার পরিবর্তে গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইন কিংবা ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারে। ফলে জরিপে আপাতত এগিয়ে থাকলেও মিশিগানে স্বস্তিতে নেই কমলা।
যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে আরেক ব্যাটল গ্রাউন্ড অ্যারিজোনার অবস্থান। এই রাজ্যের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ আফ্রিকান-আমেরিকান, সমসংখ্যক রেড ইন্ডিয়ান। এছাড়া হিস্পানিক মানুষ আছে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। যে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প সবসময় উচ্চকণ্ঠ, সেই অভিবাসীদের বড় অংশটি এই রাজ্যেই। বলা হচ্ছে, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গেম চেঞ্জার হতে পারে এই অ্যারিজোনা। ১১টি ইলেকটোরাল ভোট থাকা এই রাজ্য প্রথাগতভাবে রিপাবলিক পার্টির ঘাঁটি হলেও ১৯৯৬ সালে বিল ক্লিনটন এবং ২০২০ সালে জো বাইডেনের পক্ষে রায় দিয়েছিল। তবে এ বছর অ্যারিজোনার পুরোনো শিবিরে ফেরার পূর্বাভাস মিলেছে।
মেরিস্ট কলেজ, ইউএসএ টুডে ও সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ জরিপ বলছে, অ্যারিজোনায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের চেয়ে ১ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে, ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের সর্বশেষ জরিপের তথ্য বলছে, অ্যারিজোনায় ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। কমলা হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসাবে ২ দশমিক ১ শতাংশ সমর্থনে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। এই রাজ্যে ভোটাররা সীমান্ত নিয়ে প্রার্থীদের অবস্থান দেখে ভোট দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা মেক্সিকোর সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে রাজ্যটির। এখানে প্রচারে অভিবাসন বিরোধী নীতিকে শক্তভাবে কাজে লাগাতে চাইছেন ট্রাম্প।
১০ ইলেকটোরাল ভোটের আরেক দোদুল্যমান রাজ্য উইসকনসিনে গত ছয় নির্বাচনের পাঁচটিতে জয়লাভ করেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীরা। তবে যে একটিতে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন, সেই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ রাজ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টি ভালো করলেও প্রতিবারই জিতেছে খুবই সামান্য ব্যবধানে। এবারের রিপাবলিকান পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশন হয়েছে এই রাজ্যে, ট্রাম্প দলীয় নমিনেশনও নিয়েছেন এখান থেকেই। রাজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ শ্বেতাঙ্গ। ফলে উইসকনসিনের ১০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটকে টার্গেট করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ওয়াশিংটন পোস্ট-শচার স্কুল পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে এখানে এগিয়ে কমালা হ্যারিস। তাকে সমর্থন করেছেন শতকরা ৫০ ভাগ ভোটার আর ট্রাম্পকে ৪৭ ভাগ ভোটার। তবে ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের জরিপ অনুসারে,কমলা হ্যারিস এই রাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় অক্টোবরের শুরুতেও ২ শতাংশের বেশি ব্যবধানে থাকলেও বর্তমানে সেই ব্যবধান মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্যের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল কলেজ পেনসিলভানিয়ায়— ১৯টি। এবার সেখানে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন ইহুদি ভোটাররা। অধিকাংশ মার্কিন ইহুদি ভোটার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকলেও গাজা যুদ্ধের কারণে এবার তেমনটি হবে না বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশটিতে মুসলিমবিদ্বেষের মতো ইহুদিবিদ্বেষও সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের মতো ইহুদি হলেও পেনসিলভানিয়ার মোট জনসংখ্যার ৩.৩ শতাংশ ইহুদি। ট্রাম্প এবং তার দলের কর্মীরা স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনবিরোধী হলেও কমলা ফিলিস্তিনিদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল।
তাছাড়া, রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে পেনসিলভানিয়াতে। যে ঘটনা পরিণত হয় অন্যতম নির্বাচনী ইস্যুতে। ১৯টি ইলেকটোরাল কলেজের এই রাজ্য সর্বশেষ দুই নির্বাচনেই নিয়েছে বিজয়ীর পক্ষ। এবারও বিজয়ী নির্ধারণে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এবিসি নিউজের জরিপে ১ পয়েন্ট এবং ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের জরিপে শূন্য দশমিক চার শতাংশ ব্যবধানে এখানে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প। অন্যদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট-শচার স্কুল পরিচালিত জরিপে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা।
৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্য নেভাদার গভর্নর একজন রিপাবলিকান। দুই সিনেটর আবার ডেমোক্রেটিক পার্টির। ভোটারদের মধ্যে দুই দলের সমর্থক প্রায় সমান। সর্বশেষ নির্বাচনে ট্রাম্পকে মাত্র ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন বাইডেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-শচার স্কুল পরিচালিত জরিপে এখানে দুই প্রার্থীই সমান সমর্থন পেয়েছেন।
১৬ ইলেকটোরাল কলেজের গুরুত্বপূর্ণ আরেক ব্যাটল গ্রাউন্ড নর্থ ক্যারোলাইনা প্রথাগতভাবে রিপাবলিকানদের ঘাটি বলেই বিবেচিত। সর্বশেষ নির্বাচনেও এখানে জিতেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে গত কয়েকটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এখানে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে ব্যবধান কমছে ডেমোক্রেটিক পার্টির। তাছাড়া, এ রাজ্যে ২২ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকানের পাশাপাশি ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে হিস্পানিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।
তদুপরি, মোট ভোটারের ৫১ শতাংশই নারী। এসব ইকুয়েশনের কারণে এটি রূপ নিয়েছে সুইং স্টেটে। এ রাজ্যে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা বারবার পরাজিত হলেও এসব সমীকরণই এবার আশা দেখাচ্ছে তাদের। মেরিস্ট কলেজের সর্বশেষ জরিপে এখানে ২ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প।
১৬টি ইলেকটোরাল কলেজের দোদুল্যমান রাজ্য জর্জিয়ায় ১৯৯২ সালের পর জো বাইডেনই প্রথম ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে গত নির্বাচনে জয়লাভ করেন। যদিও ব্যবধান ছিল খুবই সামান্য। মাত্র ১২ হাজার ভোট। এই রাজ্যের প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোটারই কৃষ্ণাঙ্গ, ফলে আশাবাদী হয়ে উঠছে ডেমোক্র্যাটরা। এখানে আগস্টের শুরু থেকে বেশ কয়েকবার উভয় প্রার্থীর অবস্থান পরিবর্তন হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। মেরিস্ট কলেজের সাম্প্রতিক এক জরিপে ট্রাম্প এবং কমলা উভয়ের জনসমর্থন দেখানো হয়েছে ৪৯ শতাংশ করে। তবে ফাইভ থার্টি এইট ডটকমের সর্বশেষ জরিপে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন ১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টা অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। এর ভেতরে যে প্রার্থী ২৭০ বা তার বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পান, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে যেই নির্বাচিত হোন না কেন, ৭টি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেটের এই ৯৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটই নির্ধারণ করবে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতু্ন প্রেসিডে্ন্ট।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।