বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নির্মূলে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পরিচালিত হত্যা-গণহত্যায় জড়িত, নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু কবে থেকে বিচার শুরু হবে এবং বিচারের প্রক্রিয়া কী হবে তা জানা যায়নি। এরইমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে র্যাব-পুলিশ প্রধান, এমনকি সাবেক সেনাপ্রধানসহ সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। এমনকি জুলাই-আগস্টে গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নামেও ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের মধ্যে হওয়া গুম এবং ২০২৪ সালে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন টিম এবং তদন্ত সংস্থা নিয়োগ করা হলেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়নি কোনো বিচারক। খুব কাছাকাছি সময়ে বিচারক নিয়োগ হবে বলে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম অ্যাটর্নি জেনারেলের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। বাকি চার প্রসিকিউটরের মধ্যে মো. মিজানুল ইসলাম অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আব্দুল্লাহ আল নোমান সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদা পাবেন।
যদিও এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য পাঁচজন প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ১০ জন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রসিকিউশন কাজ শুরু করেছে। সাবেক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মাজহারুল হক তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে রয়েছেন। এখন শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগের পালা তবে, কবে কখন সেটাই দেখার অপেক্ষায় বিচারপ্রার্থী ও বিশ্লেষকরা।
কিন্তু এখন জল্পনা-কল্পনা চলছে কাকে বিচারক নিয়োগ করা হবে, তিনি কেমন হবেন। বিচারক নিয়োগে কোনো প্রশ্ন বা অসচ্ছতা হবে কি না এবং নিয়োগের পর তাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয় কি না তা নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ চলছে। এরপরই বিচারক নিয়োগ হবে বলে জানা গেছে।
আমাদের সক্ষমতা আছে বিচার করার। আমাদের ন্যাশনাল ইমোশনের ব্যাপার আছে, আমরা এই বিচার প্রক্রিয়ার খুব কাছাকাছি থাকতে চাই। এটার জন্য সব কিছু বিবেচনায় আমাদের অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল আছে সেটা প্রেফার করেছি। আমরা এখানে প্রতিশোধ না সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের জন্য অনুষ্ঠিত সেমিনারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের কাজ এখন কোর্টটা রি-কনস্টিটিউট করা। কারণ এখানে কোনো বিচারক নেই। এটা আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য, একইসঙ্গে আমদের যত আইনগত সংস্কার আছে এই সংস্কারের আলোচনাও থেমে থাকবে না। আমাদের এখানে যারা এক্সপার্ট আছেন, সবার কাছে পাঠাবো।
তিনি বলেন, আমাদের সক্ষমতা আছে বিচার করার। আমাদের ন্যাশনাল ইমোশনের ব্যাপার আছে, আমরা এই বিচার প্রক্রিয়ার খুব কাছাকাছি থাকতে চাই। এটার জন্য সবকিছু বিবেচনায় আমাদের অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল আছে সেটা প্রেফার করেছি। আমরা এখানে প্রতিশোধ না সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।
আদালত এখনো গঠিত হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা এখন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রসিকিউশনে ২০ থেকে ২৫ জন প্রসিকিউটর দরকার। আমরা মাত্র এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছি, চারজন যোগদান করেছেন। এর বাইরে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ব্যাপার রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর সময় কাঠামো নিয়ে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্য করা যায় না।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই ও আগস্টে ‘দেশব্যাপী গণ-হত্যার যেসব অপরাধ হয়েছে, যেগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেগুলোর বিচার শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের আগে কোনো থানায় বা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা হলে সেগুলো প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসবো। সেই তদন্তটা মূলত করবে আমাদের তদন্ত সংস্থা। তদন্ত করে তা ট্রাইব্যুনালের কাছে মামলা আকারে উপস্থাপন করবো। সেক্ষেত্রে মামলা কয়টা হবে, সে বিষয়টা পরবর্তীসময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানো হবে।’
বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর সময়কাঠামো প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, আদালত এখনো গঠিত হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা এখন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রসিকিউশনে ২০ থেকে ২৫ জন প্রসিকিউটর দরকার। আমরা মাত্র এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছি, চারজন যোগদান করেছেন। এর বাইরে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ব্যাপার রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর সময়কাঠামো নিয়ে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্য করা যায় না।
আগের মামলা ২৯টি, নতুন অভিযোগ ৩৫টি
এখন পর্যন্ত গণহত্যা ও গুমের ঘটনায় অভিযোগ জমা পড়েছে ৩৫টি। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১০ সাল থেকে বিচার শুরু হওয়ার পর এখনো ২৯টি আগের মামলা বিচার প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে কোনো কোনোটি চার্জ গঠনের জন্য, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলমান এবং কোনোটি যুক্তিতর্ক পর্যায়ে। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলে এখন পর্যন্ত প্রসিকিউশনের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গণহত্যা ও গুমসহ ৩৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও তদন্ত সংস্থার সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের অন্যতম সদস্য বিএম সুলতান মাহমুদ জাগো নিউজকে জানান, আমাদের প্রসিকিউশনে এখন পর্যন্ত ৩৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
প্রসিকিউটরদের পদত্যাগ ও ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া যেভাবে শুরু
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার গত ১৩ জুলাই অবসরে যান। এরপরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তারপর পরই একের পর এক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তথা প্রসিকিউটর পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের সর্বশেষ একজন সদস্য বিচারপতি হাইকোর্টে ফিরে যান। বর্তমানে বিচারপতিশূন্য ট্রাইব্যুনাল। এরই ধারাবাহিকতায় চলছে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তথা প্রসিকিউশন নিয়োগ
এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে গত ৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যিনি একই ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে লড়েছেন। তাজুল ইসলাম ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে আরও চার আইনজীবীকে প্রসিকিউটর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম অ্যাটর্নি জেনারেলের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। বাকি চার প্রসিকিউটরের মধ্যে মো. মিজানুল ইসলাম অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আব্দুল্লাহ আল নোমান সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদা পাবেন। দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর সেকশন ৭ অনুসারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা পরিচালনার জন্য পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিয়োগ কার্যকর থাকবে।
তদন্ত সংস্থা পুর্নগঠন
এরপর গত ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা হলেন- পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. মাজহারুল হক, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মুহম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরী, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর, পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. মনিরুল ইসলাম, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জানে আলম খান, পুলিশের ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল ঢাকার সহকারী পুলিশ সুপার সৈয়দ আব্দুর রউফ, সিআইডি ঢাকা মেট্রোর পুলিশ পরিদর্শক মো. ইউনুস, চারঘাট মডেল থানা রাজশাহীর পুলিশ পরিদর্শক মো. মাসুদ পারভেজ, আরআরএফ ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ আলমগীর সরকার, সিআইডি ঢাকা মেট্রো (উত্তর) পুলিশ পরিদর্শক মো. মশিউর রহমান।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের অধীনে পরিচালিত বিচার অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তদন্তকার্য সম্পাদন ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনকে সহায়তা করবেন। বলা হয়, তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন এবং জনবল নিয়োগ, অন্তর্ভুক্তকরণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে ইতোপূর্বে জারি করা প্রজ্ঞাপনসমূহ বাতিল বলে গণ্য হবে। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউর মো. তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেল শিগগির পুনর্গঠন করা হবে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ট্র্যাইব্যুনাল পুনর্গঠন বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন। শিগগির ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে।
নিহত-আহতদের তথ্য চেয়ে সিভিল সার্জন, ডিসি, এসপি ও সংশ্লিষ্টদের চিঠি
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় বিগত সরকারের নির্দেশে পরিচালিত গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সব গণমাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, সিভিল সার্জন, প্রত্যেক জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে আমরা হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আহ্বান জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন কবরস্থান পরিচালনাকারীদের কাছেও তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনের সবচাইতে বড় সাক্ষী হচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। এ বিচারের সবচেয়ে বড় সাক্ষী তারা। আমরা এ আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নিয়েছি।
আসামি কারা, অভিযোগ কী
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা-গণহত্যার শিকার ও গুলিতে আহতদের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল হচ্ছে। এসব অভিযোগে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা ও ক্যাডারদের আসামি করা হচ্ছে। আসামি উসকানিদাতা সাংবাদিকরাও। এমনকি জুলাই-আগস্টে গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নামেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়েছে।
এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আইনজীবী ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নিঝুম মজুমদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামালকে আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগে সাংবাদিকদের অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়, ২০ থেকে ৪৯ নম্বর আসামিরা (অভিযোগ অনুযায়ী) আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যাকে বৈধতা দিতে প্ররোচনা ও উসকানি দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাদের দাবি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা খবর প্রচার করেছেন। পাশাপাশি আহত ও নিহতদের সঠিক তথ্য গোপনের উদ্দেশ্যে টকশো, কলাম লিখে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য আড়াল করে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ৬ জনের দণ্ড কার্যকর
মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে জামায়াতের পাঁচ শীর্ষ নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। স্কাইপি কেলেঙ্কারি, সাক্ষী গুম ও ন্যায়বিচারবঞ্চিত হওয়ার নানা অভিযোগ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তবে এবার নবনিযুক্ত প্রসিকিউশনের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর। স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার করতে আমাদের যা যা করণীয় সবই করা হবে।
ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের খসড়ায় দল নিষিদ্ধসহ ৮ প্রস্তাব
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যুক্ত করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিসহ আইনে পাঁচটি ধারা-উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩’ সংশোধনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় খসড়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, যত ক্রন্দন থাক, ক্ষোভ থাকুক, বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সবাই দেখেছে, কী ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। একটা দেশের বৃদ্ধ প্রজন্ম একটা তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় নেমেছিল।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ বলেন, যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত নয়। আরও আলাপ–আলোচনা চলবে। তারপর আইনটা পরিপূর্ণ করা হবে।
আলোচনার মধ্য দিয়ে আইনটি সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, সব দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সম্মিলিতভাবে হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো (জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড) চায়, বিচার যেন নিশ্চিত হয়।