বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর শুভাগমন পৃথিবীবাসীর জন্য রহমত। আল্লাহতায়ালা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন আর মহানবিকে (সা.) করেছেন সবার জন্য অনুসরণীয় ও আদর্শ স্বরূপ।
আমরা সবাই এটা ঠিকই জানি যে, আল্লাাহতায়ালার ভালোবাসা পেতে হলে শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। এ বিষয়টি আমাদের সবার জানা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু মহনবীর (সা.) আদর্শ পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলছিনা আর এর ফলেই আমরা পদে পদে বিপথগামী হচ্ছি।
মহানবি (সা.) ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের ঘোরতর শত্রু ও কাফেরের লাশকেও তিনি (সা.) সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং তার উম্মতকেও তা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। হাদিস পাঠে জানা যায় যে, একবার হজরত সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও হজরত কায়স ইবনে সাদ (রা.) কাদসিয়াতে বসা ছিলেন, তখন লোকেরা তাদের সামনে দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হল, এটা এ দেশীয় অমুসলিম জিম্মি ব্যক্তির জানাজা। তখন এই সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ বললেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে দিয়েও একটি জানাজা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাকে বলা হয়েছিল, এটা তো এক ইহুদির জানাজা। তিনি ইরশাদ করেছিলেন, সে কি একজন মানুষ নয়?’ (বুখারি কিতাবুল জানায়েয, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নম্বর ১২৩৪)
কত চমৎকার শিক্ষাই না তিনি রেখে গেছেন। এই শিক্ষা অবলম্বন করলে কি কোনো অশান্তি দেখা দিতে পারে? যদিও সমস্ত বিশ্বে আজ অশান্তি বিরাজ করছে। অথচ বিশ্বনবি, হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র বিশ্বময় শান্তির বার্তা নিয়েই এসেছেন। আর তিনি নিজ কর্মময় দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেনও। কিন্তু আজ সর্বত্র কেন অশান্তি? এর মূল কারণ হলো আমরা সেই মহান ও শ্রেষ্ঠ রাসুলের আদর্শ ভুলে গিয়ে জগতের মোহে ডুবে আছি আর এর ফলেই জগতময় বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা আর অশান্তি। তাই বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মহানবির আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
মহানবি (সা.) শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদেরকে ইসলামি আদবকায়দা শেখাতেন। সত্যভাষণ ও সত্যকথন আর সত্যপ্রতিষ্ঠা এবং মিথ্যার প্রতি ছিল তার ঘৃণা। তিনি মিথ্যাকে সহ্যই করতে পারতেন না। আল্লাহতায়ালার তৌহিদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যও এটি একান্ত আবশ্যক বিষয়। আল্লাহতায়ালা শিরক ও মিথ্যাকে পরিহার করার বিষয়টিকে একই স্থানে উল্লেখ করেছেন।
এজন্য শিশুদেরকেও তিনি (সা.) প্রথম পাঠ এটিই দিতেন যে, সত্য কথা বল। আর পিতা-মাতাদেরকেও এ কথাই বলতেন, শিশুদেরকে সত্য বলা শেখাও। একইভাবে প্রত্যেক নবাগত মুসলমানের জন্যও এই উপদেশই থাকতো যে, সত্যকে অবলম্বন কর, সদা সত্য বল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য আর সন্তানদের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন সেকথা একটি হাদিস থেকে জানা যায়।
আব্দুল্লাহ বিন আমের (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মহানবি (সা.) একবার আমাদের বাড়িতে তশরিফ নিয়ে আসেন। আমি তখন অল্পবয়স্ক বালক ছিলাম। আমি খেলার জন্য যাচ্ছিলাম তখন আমার মা বলেন, আব্দুল্লাহ এদিকে আসো! আমি তোমাকে কিছু দেবো। মহানবি (সা.) বলেন, তুমি কি আসলেই তাকে কিছু দিবে? আমার মা বলেন, নিশ্চয়, খেজুর দেবো। মহানবি (সা.) বলেন, যদি সত্যিকার অর্থে তোমার এমন ইচ্ছা না থাকত আর শুধু সন্তানকে ডেকে আনার জন্য এমনটি বলতে তাহলে তোমার মিথ্যা বলার গুনাহ হতো।’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল)
শুধু রবিউল আউয়াল মাসেই রাসুলের (সা.) ভালোবাসাকে সীমিত না রেখে বছরের প্রতিটি দিনে, প্রতিক্ষণে, প্রতি মাসে মোটকথা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার (সা.) সুন্নতের অনুসরণের মাধ্যমে এবং তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমরা নিজেকে তার প্রকৃত উম্মত হিসেবে দাবি করতে পারব।
সেই অল্প বয়সেই মহানবির (সা.) এই উপদেশ শিশুর মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। এখন যে সন্তানের প্রতিপালন এমন পরিবেশে এবং এরূপ উপদেশের মধ্যে হয় সে জীবনভর কখনও মিথ্যা বলতে পারে কী? এভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত সন্তানরাই পরবর্তীতে বিশ্বকে সত্যপথ প্রদর্শনকারী হয়ে থাকে।
এরপর তিনি (সা.) বড় মনের পরিচয় দিয়ে দুঃখ-কষ্ট পেলেও সবকিছু সহ্য করতেন আর কোন চরম অপছন্দনীয় ব্যক্তিও তার (সা.) কাছে এসে গেলে তার সাথেও তিনি (সা.) কখনও দুর্ব্যবহার বা অনৈতিক আচরণ করেন নি। কেউ ভুল কাজ করে বসলে তাও তিনি উত্তমভাবে সহ্য করতেন। অনেক সময় অনেক বেদুইন, গ্রাম্য মানুষ আসতো আর তারা এমন এমন কাজ করে বসতো যাতে সাহাবিদের অনেক রাগ ধরতো কিন্তু মহানবি (সা.) তাদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন, কখনোই রাগ করেন নি।
মহানবির সর্বোত্তম নৈতিক গুণাবলি এবং ব্যাকুল চিত্তের দোয়া আর অনবরত সহানুভূতিপূর্ণ উপদেশের ফলেই প্রত্যেক হৃদয়ে, পরিবারে আর পরিবেশে পবিত্র পরিবর্তন আসা আরম্ভ হয়ে যেতো। তার সুন্দর ব্যবহার এরূপ হৃদয়কাড়া আর এমন আকর্ষণ-আবেদন ছিল আর তাতে এমন জ্যোতি ছিল যা হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করতো।
সাহাবা রেযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম বর্ণনা করেন, তিনি পরম সহানুভূতিশীল, কোমল প্রকৃতি এবং সহিষ্ণু স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যেক মুসলমানের সাথে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি (সা.) বলতেন, কোমলতা বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। যে বিষয় হতে নম্রতা বা কোমলতা বের করে দেয়া হয় তা অসুন্দর হয়ে যায়। একজন সাহাবি বর্ণনা করেন, একবার এক যুদ্ধের সময় ভিড়ের কারণে আমার পা মহানবির (সা.) পায়ের ওপর পড়ে, আমার শক্ত জুতার কারণে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন তিনি (সা.) তার লাঠি দিয়ে একথা বলে আমার পা সরিয়ে দেন যে, বিসমিল্লাহ! তুমি আমার পা’কে ক্ষত-বিক্ষত করেছ। এতে আমার খুবই অনুশোচনা হয়। পুরো রাত চিন্তিত থাকি।
পরের দিন কেউ আমার নাম ধরে ডেকে বলে, হুজুর (সা.) তোমাকে ডাকছেন। আমি চরম ভীতি নিয়ে এই ভেবে তার সমীপে উপস্থিত হই যে, সম্ভবত এখন শাস্তি পাবো। কিন্তু তিনি পরম স্নেহের সাথে বলেন, গতকাল আমি আমার লাঠি দ্বারা তোমার পা সরিয়ে দিয়েছিলাম এজন্য আমি খুবই লজ্জিত। এর বিনিময়ে এই আশিটি ছাগল উপহার দিচ্ছি, গ্রহণ করো আর এ বিষয়টি মন থেকে বের করে দাও অর্থাৎ ভুলে যাও। (মুসনাদ দারমি, হাদিকাতুস সালেহিন, পৃ: ৫৭)
মহানবির (সা.) সুন্দর আচার-ব্যবহারের সুখ্যাতি শুনে দূরদূরান্ত হতে মানুষ, বিশেষ করে যুবকশ্রেণি বিভিন্ন অঞ্চল হতে দলে দলে এসে দিনের পর দিন মদিনায় অবস্থান করতো আর তার সাথে নামাজ পড়তো এবং পবিত্র কোরআন আর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিখতো। তারা সবাই এ কথাই বলতো, তিনি অত্যন্ত কোমলমতি ও নরম হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আর পরম স্নেহের সাথে তাদেরকে ধর্মের শিক্ষা দিতেন। মহানবির কথায় এমন প্রভাব ছিল যে, সাহাবিগণ তার ভালোবাসা, সন্তুষ্টি এবং দোয়া লাভের জন্য ছিলেন পাগলপারা আর তার প্রতিটি কথার ওপর আমল করার জন্য তারা থাকতেন সদা ব্যাকুল। তারা নামাজ পড়ার ও রোযা রাখার ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন।
অনেক সময় মহানবিকে (সা.) তাদের একথাও বুঝাতে হতো যে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমাদের দেহেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের চোখেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের স্ত্রী এবং পরিবার-পরিজনেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের বাড়িতে আগত অতিথিরও তোমাদের ওপর প্রাপ্য আছে। (সহিহ বুখারি)
মহানবি (সা.) সাদা-কালো, ধনী-গরীব সবার মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা এ পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে তার (সা.) সম্পর্কে অনেক বেশি আলোচনা করছি ঠিকই কিন্তু নিজ জীবনে কতটা বাস্তবায়ন করেছি তাও ভেবে দেখতে হবে।
তাই শুধু রবিউল আউয়াল মাসেই রাসুলের (সা.) ভালোবাসাকে সীমিত না রেখে বছরের প্রতিটি দিনে, প্রতিক্ষণে, প্রতি মাসে মোটকথা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার (সা.) সুন্নতের অনুসরণের মাধ্যমে এবং তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমরা নিজেকে তার প্রকৃত উম্মত হিসেবে দাবি করতে পারব।
আল্লাহপাক আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]
আমরা সবাই এটা ঠিকই জানি যে, আল্লাাহতায়ালার ভালোবাসা পেতে হলে শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। এ বিষয়টি আমাদের সবার জানা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু মহনবীর (সা.) আদর্শ পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলছিনা আর এর ফলেই আমরা পদে পদে বিপথগামী হচ্ছি।
মহানবি (সা.) ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের ঘোরতর শত্রু ও কাফেরের লাশকেও তিনি (সা.) সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং তার উম্মতকেও তা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। হাদিস পাঠে জানা যায় যে, একবার হজরত সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও হজরত কায়স ইবনে সাদ (রা.) কাদসিয়াতে বসা ছিলেন, তখন লোকেরা তাদের সামনে দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হল, এটা এ দেশীয় অমুসলিম জিম্মি ব্যক্তির জানাজা। তখন এই সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ বললেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে দিয়েও একটি জানাজা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাকে বলা হয়েছিল, এটা তো এক ইহুদির জানাজা। তিনি ইরশাদ করেছিলেন, সে কি একজন মানুষ নয়?’ (বুখারি কিতাবুল জানায়েয, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নম্বর ১২৩৪)
কত চমৎকার শিক্ষাই না তিনি রেখে গেছেন। এই শিক্ষা অবলম্বন করলে কি কোনো অশান্তি দেখা দিতে পারে? যদিও সমস্ত বিশ্বে আজ অশান্তি বিরাজ করছে। অথচ বিশ্বনবি, হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র বিশ্বময় শান্তির বার্তা নিয়েই এসেছেন। আর তিনি নিজ কর্মময় দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেনও। কিন্তু আজ সর্বত্র কেন অশান্তি? এর মূল কারণ হলো আমরা সেই মহান ও শ্রেষ্ঠ রাসুলের আদর্শ ভুলে গিয়ে জগতের মোহে ডুবে আছি আর এর ফলেই জগতময় বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা আর অশান্তি। তাই বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মহানবির আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
মহানবি (সা.) শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদেরকে ইসলামি আদবকায়দা শেখাতেন। সত্যভাষণ ও সত্যকথন আর সত্যপ্রতিষ্ঠা এবং মিথ্যার প্রতি ছিল তার ঘৃণা। তিনি মিথ্যাকে সহ্যই করতে পারতেন না। আল্লাহতায়ালার তৌহিদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যও এটি একান্ত আবশ্যক বিষয়। আল্লাহতায়ালা শিরক ও মিথ্যাকে পরিহার করার বিষয়টিকে একই স্থানে উল্লেখ করেছেন।
এজন্য শিশুদেরকেও তিনি (সা.) প্রথম পাঠ এটিই দিতেন যে, সত্য কথা বল। আর পিতা-মাতাদেরকেও এ কথাই বলতেন, শিশুদেরকে সত্য বলা শেখাও। একইভাবে প্রত্যেক নবাগত মুসলমানের জন্যও এই উপদেশই থাকতো যে, সত্যকে অবলম্বন কর, সদা সত্য বল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য আর সন্তানদের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন সেকথা একটি হাদিস থেকে জানা যায়।
আব্দুল্লাহ বিন আমের (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মহানবি (সা.) একবার আমাদের বাড়িতে তশরিফ নিয়ে আসেন। আমি তখন অল্পবয়স্ক বালক ছিলাম। আমি খেলার জন্য যাচ্ছিলাম তখন আমার মা বলেন, আব্দুল্লাহ এদিকে আসো! আমি তোমাকে কিছু দেবো। মহানবি (সা.) বলেন, তুমি কি আসলেই তাকে কিছু দিবে? আমার মা বলেন, নিশ্চয়, খেজুর দেবো। মহানবি (সা.) বলেন, যদি সত্যিকার অর্থে তোমার এমন ইচ্ছা না থাকত আর শুধু সন্তানকে ডেকে আনার জন্য এমনটি বলতে তাহলে তোমার মিথ্যা বলার গুনাহ হতো।’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল)
শুধু রবিউল আউয়াল মাসেই রাসুলের (সা.) ভালোবাসাকে সীমিত না রেখে বছরের প্রতিটি দিনে, প্রতিক্ষণে, প্রতি মাসে মোটকথা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার (সা.) সুন্নতের অনুসরণের মাধ্যমে এবং তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমরা নিজেকে তার প্রকৃত উম্মত হিসেবে দাবি করতে পারব।
সেই অল্প বয়সেই মহানবির (সা.) এই উপদেশ শিশুর মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। এখন যে সন্তানের প্রতিপালন এমন পরিবেশে এবং এরূপ উপদেশের মধ্যে হয় সে জীবনভর কখনও মিথ্যা বলতে পারে কী? এভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত সন্তানরাই পরবর্তীতে বিশ্বকে সত্যপথ প্রদর্শনকারী হয়ে থাকে।
এরপর তিনি (সা.) বড় মনের পরিচয় দিয়ে দুঃখ-কষ্ট পেলেও সবকিছু সহ্য করতেন আর কোন চরম অপছন্দনীয় ব্যক্তিও তার (সা.) কাছে এসে গেলে তার সাথেও তিনি (সা.) কখনও দুর্ব্যবহার বা অনৈতিক আচরণ করেন নি। কেউ ভুল কাজ করে বসলে তাও তিনি উত্তমভাবে সহ্য করতেন। অনেক সময় অনেক বেদুইন, গ্রাম্য মানুষ আসতো আর তারা এমন এমন কাজ করে বসতো যাতে সাহাবিদের অনেক রাগ ধরতো কিন্তু মহানবি (সা.) তাদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন, কখনোই রাগ করেন নি।
মহানবির সর্বোত্তম নৈতিক গুণাবলি এবং ব্যাকুল চিত্তের দোয়া আর অনবরত সহানুভূতিপূর্ণ উপদেশের ফলেই প্রত্যেক হৃদয়ে, পরিবারে আর পরিবেশে পবিত্র পরিবর্তন আসা আরম্ভ হয়ে যেতো। তার সুন্দর ব্যবহার এরূপ হৃদয়কাড়া আর এমন আকর্ষণ-আবেদন ছিল আর তাতে এমন জ্যোতি ছিল যা হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করতো।
সাহাবা রেযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম বর্ণনা করেন, তিনি পরম সহানুভূতিশীল, কোমল প্রকৃতি এবং সহিষ্ণু স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যেক মুসলমানের সাথে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি (সা.) বলতেন, কোমলতা বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। যে বিষয় হতে নম্রতা বা কোমলতা বের করে দেয়া হয় তা অসুন্দর হয়ে যায়। একজন সাহাবি বর্ণনা করেন, একবার এক যুদ্ধের সময় ভিড়ের কারণে আমার পা মহানবির (সা.) পায়ের ওপর পড়ে, আমার শক্ত জুতার কারণে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন তিনি (সা.) তার লাঠি দিয়ে একথা বলে আমার পা সরিয়ে দেন যে, বিসমিল্লাহ! তুমি আমার পা’কে ক্ষত-বিক্ষত করেছ। এতে আমার খুবই অনুশোচনা হয়। পুরো রাত চিন্তিত থাকি।
পরের দিন কেউ আমার নাম ধরে ডেকে বলে, হুজুর (সা.) তোমাকে ডাকছেন। আমি চরম ভীতি নিয়ে এই ভেবে তার সমীপে উপস্থিত হই যে, সম্ভবত এখন শাস্তি পাবো। কিন্তু তিনি পরম স্নেহের সাথে বলেন, গতকাল আমি আমার লাঠি দ্বারা তোমার পা সরিয়ে দিয়েছিলাম এজন্য আমি খুবই লজ্জিত। এর বিনিময়ে এই আশিটি ছাগল উপহার দিচ্ছি, গ্রহণ করো আর এ বিষয়টি মন থেকে বের করে দাও অর্থাৎ ভুলে যাও। (মুসনাদ দারমি, হাদিকাতুস সালেহিন, পৃ: ৫৭)
মহানবির (সা.) সুন্দর আচার-ব্যবহারের সুখ্যাতি শুনে দূরদূরান্ত হতে মানুষ, বিশেষ করে যুবকশ্রেণি বিভিন্ন অঞ্চল হতে দলে দলে এসে দিনের পর দিন মদিনায় অবস্থান করতো আর তার সাথে নামাজ পড়তো এবং পবিত্র কোরআন আর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিখতো। তারা সবাই এ কথাই বলতো, তিনি অত্যন্ত কোমলমতি ও নরম হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আর পরম স্নেহের সাথে তাদেরকে ধর্মের শিক্ষা দিতেন। মহানবির কথায় এমন প্রভাব ছিল যে, সাহাবিগণ তার ভালোবাসা, সন্তুষ্টি এবং দোয়া লাভের জন্য ছিলেন পাগলপারা আর তার প্রতিটি কথার ওপর আমল করার জন্য তারা থাকতেন সদা ব্যাকুল। তারা নামাজ পড়ার ও রোযা রাখার ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন।
অনেক সময় মহানবিকে (সা.) তাদের একথাও বুঝাতে হতো যে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমাদের দেহেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের চোখেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের স্ত্রী এবং পরিবার-পরিজনেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের বাড়িতে আগত অতিথিরও তোমাদের ওপর প্রাপ্য আছে। (সহিহ বুখারি)
মহানবি (সা.) সাদা-কালো, ধনী-গরীব সবার মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা এ পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে তার (সা.) সম্পর্কে অনেক বেশি আলোচনা করছি ঠিকই কিন্তু নিজ জীবনে কতটা বাস্তবায়ন করেছি তাও ভেবে দেখতে হবে।
তাই শুধু রবিউল আউয়াল মাসেই রাসুলের (সা.) ভালোবাসাকে সীমিত না রেখে বছরের প্রতিটি দিনে, প্রতিক্ষণে, প্রতি মাসে মোটকথা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার (সা.) সুন্নতের অনুসরণের মাধ্যমে এবং তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমরা নিজেকে তার প্রকৃত উম্মত হিসেবে দাবি করতে পারব।
আল্লাহপাক আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]