ঢাকা , শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫ , ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

বালিয়াডাঙ্গীর ‘মেহমানখানা’: যেখানে ভিক্ষুকও পান অতিথির মর্যাদা

দৈনিক মার্তৃভূমির খবর
আপলোড সময় : ০১-০৮-২০২৫ ০৮:৫৪:০৬ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০১-০৮-২০২৫ ০৮:৫৪:০৬ অপরাহ্ন
বালিয়াডাঙ্গীর ‘মেহমানখানা’: যেখানে ভিক্ষুকও পান অতিথির মর্যাদা ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়াল ছায়া যখন নেমে আসে, তখন একদিকে মানুষ হারিয়েছিল স্বাস্থ্যসেবা, অন্যদিকে অসংখ্য অসহায় মানুষ অনাহারে দিন কাটাত। সেই ভয়াল সময়ে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফুলতলা গ্রামের হারুন অর রশিদ গ্রহণ করেন এক ব্যতিক্রমী ও মানবিক উদ্যোগ—তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মেহমানখানা’, যেখানে দুস্থ মানুষ সম্মানের সঙ্গে পেট ভরে খেতে পারেন।

২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা এই ‘মেহমানখানা’ প্রথম দিন খাওয়ায় মাত্র ৫০–৬০ জন মানুষকে। আর আজ, প্রতি শুক্রবার এখানে ১৫০–২০০ জনের বেশি অসহায় মানুষ বিনা মূল্যেই একবেলা খাবার গ্রহণ করেন। ২৯ মে অনুষ্ঠিত হয় ‘মেহমানখানা’র ১৯৭তম সাপ্তাহিক আয়োজন, যেখানে প্রায় ২৫০ জন মানুষকে খাবার পরিবেশন করা হয়।

 

শুরুর পেছনের গল্প

হারুন অর রশিদ বলেন, “করোনার সময় একদিন দুপুরে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে বললেন— ‘তিন–চারটা বাড়িতে গেছি, কেউ ভাত তো দূরের কথা, দরজাটাও খোলেনি।’ এই কথা শুনে আমি খুব কষ্ট পাই এবং তখনই সিদ্ধান্ত নিই— এমন মানুষের জন্য কিছু করতে হবে।”

শুরুতে এর নাম ছিল ‘হতভাগা সেন্টার’, পরে ফেসবুক বন্ধুদের পরামর্শে নামকরণ করা হয় ‘বালিয়াডাঙ্গী মেহমানখানা’।

 

সম্মানের সঙ্গে আহার

‘মেহমানখানা’ শুধু খাবার বিতরণের স্থান নয়, এটি সম্মানজনক গ্রহণযোগ্যতার একটি প্রতীক। এখানে মানুষকে চেয়ারে বসিয়ে পরিবেশন করা হয়, যেন তারা ভিক্ষুক নয়, অতিথি।

প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর শুরু হয় খাবার বিতরণ। মেনুতে থাকে ভাত, ডাল, সবজি এবং কখনও মাছ, ডিম, মুরগি কিংবা গরুর মাংস।

জিয়াখোর গ্রামের বাবুর্চি মনসুর আলী বলেন, “মেহমানখানায় রান্নার কাজ করে যে তৃপ্তি পাই, তা কোনো পারিশ্রমিকের চেয়ে বড়।”

 

একতার শক্তিতে গড়ে ওঠা উদ্যোগ

প্রথম তিন সপ্তাহ হারুন নিজেই খরচ বহন করলেও পরে ২৫ জনের বেশি সহযোগী এই কাজে যুক্ত হন। কেউ দেন অর্থ, কেউ দেন থালা-বাসন, আবার কেউ চেয়ার বা পরিবেশনার সামগ্রী।

স্বচ্ছতা রক্ষায় প্রতিটি ব্যয়ের বিবরণ ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, “এটি ব্যতিক্রম ও মানবিক একটি উদ্যোগ। এমন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়লে এলাকার অসহায় মানুষের কষ্ট অনেকটা কমে যাবে।”

সংগঠক আবু শাহীন জানান, “আমরা কাউকে আমন্ত্রণ জানাই না, নির্দিষ্ট কারও কাছে কিছু চাই না। কেউ স্বেচ্ছায় যা দেন, তা-ই গ্রহণ করি।”

 

মানবিকতার প্রতীক

স্থানীয় গৃহবধূ জরিনা বেগম বলেন, “এখানে খেতে এসে কখনও ছোট মনে হয় না। সবাই খুব ভালো ব্যবহার করেন।”

মহাসিন আলী বলেন, “এখানে এসে মনে হয় আমরা মেহমান—এখানে কেউ দয়া করে খাওয়ায় না, ভালোবাসা দিয়ে খাওয়ায়।”

 

সামাজিক স্বীকৃতি ও প্রশাসনের সাড়া

বালিয়াডাঙ্গী লাহিড়ী বড় মসজিদের ইমাম মুফতি নুর হোসাইন বলেন, “এক মুঠো খাবার দিয়ে কোনো অসহায় মানুষকে সম্মান জানানো সত্যিই মহৎ কাজ। আল্লাহ যেন এই আয়োজনকে টিকিয়ে রাখেন।”

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী আল মামুন জীবন বলেন, “চার বছর পেরিয়ে বহু গ্লাস, প্লেট, চেয়ার নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মানবিক মানুষের সহযোগিতা পেলে খাবারের মান আরও উন্নত করা সম্ভব।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ কুমার দেবনাথ বলেন, “হারুন অর রশিদের এ উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।”

 

মানবতা অব্যাহত থাকুক

‘মেহমানখানা’ পরিচালনার জন্য প্রতি শুক্রবার গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়, যা আসে হারুন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।

এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া হয়েছে এই আয়োজনের মাধ্যমে।

হারুন অর রশিদ বলেন, “যখন একটি উদ্যোগ সকলের হয়ে যায়, তখন সেটা আর থেমে থাকে না। আমার বিশ্বাস, মেহমানখানা একটি চলমান আলোর নাম।”


নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ