বিশ্বজুড়ে আজ মুসলমানরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কোথাও তারা দখলদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে, কোথাও জাতিগত নিধনের শিকার হচ্ছে, আবার কোথাও তারা পরিচয় হারানোর যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো— এত বড় বড় ঘটনার পরও বিশ্ববাসীর সামনে সেগুলোর সঠিক চিত্র খুব কমই আসে। কারণ একটাই— বিশ্বমিডিয়া মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সাম্প্রতিক ইরান-ই-স-রা-য়ে-ল সংকটই এর জীবন্ত প্রমাণ। এছাড়াও ই-স-রা-য়ে-ল যখন গাজায় হাজার হাজার নিরপরাধ নারী-শিশুকে হত্যা করে, হাসপাতাল ও স্কুলে বোমাবর্ষণ করে— তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো বেশিরভাগ সময় সেটিকে “আত্মরক্ষামূলক হামলা” বলে চালিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে, ইরান যখন পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় একটি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, তখন সেটিকেই “উসকানিমূলক হামলা” হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ মূলত অমুসলিমদের হাতে। ফলে মিডিয়ায় কী দেখানো হবে, কী দেখানো হবে না, কীভাবে দেখানো হবে— এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে মুসলমানদের প্রতি রয়েছে অবিশ্বাস, অবজ্ঞা এবং কখনো কখনো বিদ্বেষ। ফলে মুসলিম বিশ্বে সংঘটিত সহিংসতা, দমন-পীড়ন কিংবা গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও খুব সহজেই মিডিয়া থেকে হারিয়ে যায়, কিংবা হালকাভাবে উপস্থাপিত হয়।
অন্যদিকে, কোনো মুসলমান যদি একটি বিচ্ছিন্ন ভুল করে, সেটিকে অতিরঞ্জিত করে এমনভাবে প্রচার করা হয় যেন গোটা ইসলামই সহিংসতার ধর্ম। এর ফলে তৈরি হয় জনমনে বিভ্রান্তি, বাড়ে ইসলামবিদ্বেষ এবং মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব।
একটি জাতির দুর্দশা তখনই দীর্ঘস্থায়ী হয়, যখন তারা নিজেদের গল্প বলার মাধ্যম হারিয়ে ফেলে। মুসলিম বিশ্ব এখন সেই অবস্থাতেই রয়েছে। আমরা নিজেদের পক্ষে কথা বলার মতো শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম গড়ে তুলতে পারিনি। যার ফলে আমাদের কণ্ঠস্বর বিশ্বের কানে পৌঁছায় না, বরং অন্যদের বানানো বিকৃত গল্পই আমাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।
এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে মুসলমানদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম— এসব ব্যবহার করে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের গণমাধ্যম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। শুধু আবেগ দিয়ে নয়, প্রফেশনাল দক্ষতা, তথ্যনির্ভরতা, নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েই বিশ্বজনমত অর্জন করতে হবে।
এটা শুধু মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার মাধ্যম নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক বিশ্ব গড়ার অংশ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। যেখানে সত্য হবে মুখ্য, আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নিপীড়িত মানুষের জন্য আওয়াজ তোলা হবে প্রধান লক্ষ্য।
মিডিয়া শুধু সংবাদ প্রচারের যন্ত্র নয়, এটি একটি সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ার। মুসলিম উম্মাহ যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে চায়, তবে তাদেরকে নিজেদের কণ্ঠস্বর গড়ে তুলতেই হবে— এবং সেটা হতে হবে বিশ্বব্যাপী শোনা যায় এমন শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।