কেন আদানির জন্য সীমান্ত নিরাপত্তা 'শিথিলের' অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে
আপলোড সময় :
১৯-০৩-২০২৫ ১২:২১:০১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৯-০৩-২০২৫ ১২:২১:০১ অপরাহ্ন
ভারতের লোকসভায় বিরোধী দল কংগ্রেস ও ডিএমকে সংসদ সদস্যরা গত সপ্তাহে একটি বিশেষ ইস্যুকে কেন্দ্র সংসদে হট্টগোল সৃষ্টি করেন।
তাদের অভিযোগ ছিল, গুজরাটের কচ্ছ জেলার খাভরাস্থিত ভারত-পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সীমান্তে আদানি গ্রুপের নবায়নযোগ্য শক্তি (আরই) একটি পার্ক স্থাপনের জন্য সুরক্ষা প্রোটোকল শিথিল করে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আপোস করা হয়েছে।
এ নিয়ে কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মণীশ তিওয়ারির প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেননি নতুন ও নবায়নযোগ্য শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে।
এরপরই বিক্ষুব্ধ সাংসদরা সংসদের কার্যক্রম বয়কট করে ওয়াকআউট করেন। প্রায় এক মাসে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস বিষয়টি উত্থাপন করেছে এবং সরকারের কাছ থেকে জবাব চেয়েছে।
গত মাসে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান, গুজরাটের কচ্ছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে খাভরা রিনিউয়েবল এনার্জি পার্ক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
সেখানে অভিযোগ তোলা হয় যে, ওই প্রকল্পের জন্য ভারত সরকার সীমান্ত সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধি শিথিল করেছে, যার ফলে আদানি গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন গুজরাট সরকার কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খাভরার কাছে তিরিশ হাজার মেগাওয়াটের হাইব্রিড আরই পার্ক নির্মাণের জন্য অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সমস্ত শর্তাবলী রয়েছে, তাতে শিথিলতা চায়।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার খবরের শিরোনাম হয়েছে গৌতম আদানির এই সংস্থা। এর মধ্যে অন্যতম হলো তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওঠা প্রতারণা সংক্রান্ত অভিযোগ।
মার্কিন ফেডারেল প্রসিকিউটররা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার ব্যবসায়িক প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার সময় মি. আদানি এই তথ্য গোপন করেছিলেন যে, ওই বরাদ্দ তিনি পেয়েছেন ২৫ কোটি ডলার ঘুষ দিয়ে। যদিও তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মি. আদানি।
পুরো ব্যাপারটা কী?
যে প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি ভারত-পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওই এলাকায় বায়ু শক্তির জন্য টারবাইন জেনারেটর এবং সৌর প্যানেল স্থাপনের অনুমতির দেয়া নিয়েই বিতর্কের শুরু।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, "২০২৩ সালের ২১শে এপ্রিল একটি বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সীমান্ত সুরক্ষা সংক্রান্ত নিয়ম শিথিল করতে সম্মত হয় যাতে নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য এই জমি ব্যবহার অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হতে পারে।"
যদিও বৈঠকে উপস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম থেকেই সীমান্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিয়মাবলীতে পরিবর্তনের বিরোধিতা করে জানিয়েছিলেন, উইন্ডমিল এবং সৌর প্যানেলগুলি "ট্যাঙ্কের সমাবেশ এবং সুরক্ষা নজরদারিকে" ব্যাহত করবে।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ওই সামরিক কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে "শত্রু ট্যাঙ্কের চলাচলের ফলে সৃষ্ট যে কোনও ঝুঁকি প্রশমিত করতে সৌর প্ল্যাটফর্মগুলি যথেষ্ট।"
প্রাথমিকভাবে, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডকে (এসইসিআই) সীমান্তে ২৩০ বর্গ কিলোমিটার জমি বরাদ্দ করা হয়েছিল।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে- ২০২৩ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য নিয়ম শিথিল করে।
২০২৩ সালের ১৭ জুলাই এসইসিআই গুজরাট সরকারের হাতে জমি হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে সেই বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে ওই জমি আদানি গোষ্ঠীকে বরাদ্দ করা দেওয়া হয়েছিল।
চলতি বছরের ১২ই মার্চ, লোকসভায় কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারি বলেছিলেন, "জাতীয় নিরাপত্তা প্রোটোকলে বলা আছে, সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও বড় পরিকাঠামোর প্রকল্প করা যাবে না। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, নির্মাণাধীন খাভরা প্রকল্পের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা প্রটোকল শিথিল করা হয়েছে কি না?"
পাশাপাশি তিনি প্রশ্ন তোলেন, "দ্বিতীয়ত, ভারত সরকার এই হাইব্রিড নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প যার মধ্যে বায়ু শক্তি, সৌর শক্তি এবং অন্যান্য জিনিস রয়েছে, সেখানে কত ছাড় দিয়েছে?"
জবাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী জোর দিয়ে জানিয়েছিলেন, খাভরা পার্ক অনুমোদনের ক্ষেত্রে সমস্ত নিয়ম মানা হয়েছে।
তিনি বলেন, "আমরা দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করতে চাই। খাভরার প্রশ্নটি এর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তবুও আমি উল্লেখ করতে চাই যে যখনই কোনও প্রকল্প অনুমোদন করা হয়, তখন তা রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় সংস্থাগুলির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছ থেকে যথাযথ ছাড়পত্র এবং লাইসেন্স পাওয়ার পরেই তা কার্যকর হয়।"
খাভরা নবায়নযোগ্য শক্তি পার্ক
আনুষ্ঠানিকভাবে গুজরাট সোলার-উইন্ড হাইব্রিড রেনিউয়েবল এনার্জি পার্ক নামে পরিচিত এই পার্ক বিশ্বের বৃহত্তম পুনর্নবীকরণযোগ্য বা নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত হয়। এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর ২০২০ সালে স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
নির্মাণাধীন প্রকল্পটি একটি হাইব্রিড এনার্জি পার্ক, যেখানে বায়ু শক্তি এবং সৌর শক্তি উৎপাদন করতে বায়ু টারবাইন এবং সৌর প্যানেল ব্যবহার করা হয়।
২০২০ সালে সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, গুজরাট সরকার প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি নির্ধারণ করেছিল যদিও পরে তা কমিয়ে ৭২৬ বর্গ কিলোমিটার করে দেওয়া হয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "সেনাবাহিনীর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পার্কটি নির্মাণের জন্য ৭২ হাজার ৬০০ হেক্টর চিহ্নিত জমি ব্যবহার করার অনুমোদন দেয়।"
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, "নবায়নযোগ্য জ্বালানি পার্কে দুটি জোন থাকবে। এর মধ্যে একটি হলো ৪৯ হাজার ৬০০ হেক্টর আয়তনের হাইব্রিড পার্ক এলাকা যেখানে ২৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকবে। অন্যটি হলো ২৩ হাজার হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত একটি বিশেষ উইন্ড পার্ক।"
"বায়ু পার্ক অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ১-৬ কিলোমিটারের মধ্যে পড়বে। অন্যদিকে, হাইব্রিড পার্ক জোনটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হবে।"
গুজরাট সরকারের উদ্যোগে গুজরাট পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড খাভরা আরই পার্কের উন্নয়নে সহায়তা করছে।
ওই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজ্য সরকার প্রাথমিকভাবে গুজরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ৪৭.৫০ বর্গ কিলোমিটার এবং গুজরাট রাজ্য বিদ্যুৎ কর্পোরেশনকে (জিএসইসিএল) ৬৬.৫০ বর্গ কিলোমিটার জমি বরাদ্দ করেছিল।
ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড (এনটিপিসি) এবং সুজলন গ্রুপের সারজান রিয়েলিটিস লিমিটেডকে ৯৫-৯৫ বর্গ কিলোমিটার জমি, আদানি গ্রুপের আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড (এজিইএল) ১৯০ বর্গ কিলোমিটার এবং এসইসিআই ২৩০ বর্গ কিলোমিটার জমি বরাদ্দ করেছিল।
এসইসিআইকে বরাদ্দ করা জমি ছিল বায়ু শক্তি অবকাঠামোর জন্য। ছয়টি প্রতিষ্ঠান তাদের বরাদ্দ করা জমিতে ২ হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট, ৩ হাজার ৩২৫ মেগাওয়াট, ৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট, ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে-এমনটাই জানা গিয়েছে। এর মধ্যে এনটিপিসি এবং এসইসিআই হল কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা।
এই পার্কের গুরুত্ব
২০১৫ সালে প্যারিসে আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (সিওপি ২১) ভারত জানিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই প্রসঙ্গে, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত। তারপর থেকেই ভারত প্রতি বছর হাজার হাজার মেগাওয়াটের সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।
২০১৪ সালে ভারতের বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২৩ হাজার ৮৬৪ মেগাওয়াট। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লক্ষ ৫১ হাজার মেগাওয়াট। এই সময়, গুজরাট এবং রাজস্থানের "পতিত জমি" হিসাবে চিহ্নিত জমিতে বড় আকারে সৌর খামার স্থাপনও করা হয়।
এইভাবে প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে ভারত নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর আগেই পূরণ করে ফেলেছে। ভারত আন্তর্জাতিক সৌর জোটের সভাপতিত্ব করছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতাকে প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে ৫০০ গিগাওয়াট বা ৫ লক্ষ মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে।
এই লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে খাভরা রিনিউয়েবল এনার্জি পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
গুজরাট সরকারের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, খাভরা রিনিউয়েবল এনার্জি পার্ক ইতোমধ্যেই তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন শুরু করেছে।
গত মাসে নির্মীয়মাণ খাভরা রিনিউয়েবল এনার্জি পার্কে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য উইন্ডমিল, সোলার প্যানেল ও লাইন বসানোর কাজ যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে চলতে দেখা গিয়েছে।
যন্ত্রপাতি ও উপকরণ বোঝাই শত শত ট্রাক ভিতরে ঢোকার জন্য একটি চেকপোস্টে অপেক্ষা করছিল। আরই পার্কে ঢোকা বা বেরোনোর জন্য সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য সারিবদ্ধভাবে শত শত শ্রমিককেও অপেক্ষা করতে দেখা গিয়েছে।
গত বছর আদানির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, খাভরা আরই পার্কের আট হাজার কর্মী ও শ্রমিকের জন্য একটি টাউনশিপ তৈরি করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের শিলান্যাস বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে, খাভরা আরই পার্কে দেড় লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। জিপিসিএলের ওয়েবসাইট অনুসারে, আরই পার্কের উন্নয়ন ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
প্রকল্পটি খাভরা এবং আশেপাশের গ্রামগুলির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বাড়িয়ে তুলেছে। এর আগে, মূলত বৃষ্টিনির্ভর কৃষিকাজ এবং পশুপালনের উপর নির্ভরশীল ছিলেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা।
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক আমাদের জানিয়েছেন, তারা পণ্য ডিপো নির্মাণের জন্য ডেভেলপার এবং ঠিকাদারদের কাছে নিজেদের জমি ইজারা দিয়েছেন। কেউ কেউ ট্রাক্টর, জলের ট্যাঙ্কার, জেসিবির মতো গাড়ি কিনে এনআরই পার্কে বিভিন্ন কাজের জন্য চুক্তি করেছেন।
এই এলাকায় খাভরা গ্রাম থেকে আরই পার্ক যাওয়ার যে জাতীয় সড়ক রয়েছে, তার পাশে হোটেল এবং রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে।
আদানি গোষ্ঠীর জন্য নিয়ম বদল হয়েছিল?
আরই পার্ক এবং বিশেষত সৌর পার্কগুলির সৌর প্যানেল ইনস্টল করার জন্য প্রচুর পরিমাণে জমি প্রয়োজন। সাম্প্রতিককালে, দেশে বড় অবকাঠামো এবং খনি প্রকল্পের জন্য ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণের ইস্যুকে ঘিরে প্রতিবাদও দেখা গিয়েছে।
তবে রাজস্থান এবং গুজরাটের বিপুল আয়তনের জমিকে পতিত জমি হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। এই জাতীয় জমি সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের অধীনে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, এই দুই রাজ্যের সরকারই বায়ু এবং সৌর পার্কের জন্য এই জাতীয় জমি বরাদ্দ করেছে।
গুজরাটের কচ্ছ জেলা ৪৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা ভৌগোলিক সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বৃহত্তম জেলা। এটি গুজরাটের মোট আয়তনের প্রায় ২৪ শতাংশ।
ছোট রণ এবং কচ্ছের বড় রণ হলো এমন দু'টি মরুভূমি যা কচ্ছের উল্লেখযোগ্য অংশ। এখানে বন্যপ্রাণীদের জন্য অভয়ারণ্য রয়েছে। সেই কারণে এই জমি অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়।
এদিকে, একমাত্র সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়া ছাড়া খাভরার নিকটবর্তী জমিতে এ জাতীয় কোনও বিধিনিষেধ নেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে গুজরাটের শক্তি ও পেট্রোরসায়ন বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য সচিব বলেছিলেন, "জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে অনুর্বর জমি। দ্বিতীয়ত, সীমান্তের কাছাকাছি উইন্ডমিল স্থাপন করলে সেগুলোও সীমান্ত হিসেবে কাজ করে।"
খাভরায় আরই পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, "সীমান্তে উইন্ডমিল বসানো হলে তা সীমান্তকে আরও নিরাপদ ও উন্নত করবে। সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের বিল কমানোর উদ্দেশ্যে দেশ যে লক্ষ্য স্থির করেছে, তা অর্জন করার ক্ষেত্রেও এটি একটি পদক্ষেপ হবে।"
"সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটি দূষণ হ্রাস করবে এবং আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করবে। এই পার্ক থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাঁচ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন রোধ করবে। এটা নয় কোটি গাছ লাগানোর সমান।"
আরই পার্কের কাজ শুরু হওয়ার আগে, এই অঞ্চলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত শুধুমাত্র ইন্ডিয়া ব্রিজ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি খাভরা গ্রাম থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার এবং কচ্ছের জেলা সদর ভুজ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
অনুমতি নিয়ে তবেই পর্যটকদের সীমান্তের ভিঘাকোট পর্যন্ত যেতে দেওয়া হতো। তবে, আরই পার্কের উন্নয়নের জন্য পণ্য ও মানুষের চলাচলের অনুমতি দিতে, রাজ্য সরকার একটি ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোড তৈরি করেছে, যা ইন্ডিয়া ব্রিজকে বাইপাস করে এই অঞ্চলে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ তৈরি করেছে।
তবে, আরই পার্ক এলাকায় প্রবেশ নিয়ে এখনও অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। এর জন্য ভুজের ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি প্রয়োজন। ইন্ডিয়া ব্রিজের কাছে আরই পার্কের এন্ট্রি পয়েন্টে বসানো চেকপোস্টে বিএসএফ মোতায়েন রয়েছে।
এই জমি আদানি গোষ্ঠী কীভাবে পেল?
প্রাথমিকভাবে এসইসিআইএলকে বরাদ্দ করা জমিটি কীভাবে এবং কেন আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছিল সেই বিষয়ে গুজরাট সরকারের অবস্থান জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
তবে মন্ত্রী কানু দেশাই ও গুজরাট সরকারের মুখপাত্র মন্ত্রী ঋষিকেশ প্যাটেলকে ফোন এবং পাঠানো বার্তার কোনও জবাব পায়নি বিবিসি।
একটি সরকারি সূত্র জানিয়েছে, "আদানি গ্রুপকে এসইসিআইএল-এর জমি পুনর্বণ্টন এখনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এটি সত্যি যে খাভরা পার্কের জমির বৃহত্তম অংশ আদানি গ্রুপের আওতায় রয়েছে।"
অন্য একটি সূত্র অনুযায়ী, "৪০ বছরের লিজে রাজ্য সরকারের একটি কমিটি সরাসরি ডেভেলপারদের ওই জমি বরাদ্দ করে থাকে। ডেভেলপাররা প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৫ লক্ষ টাকা করে লিজ বাবদ সরকারকে দেয় এবং তাদের এই জাতীয় জমি ভাড়া দেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।"
কচ্ছে আদানি গ্রুপের উপস্থিতি
কচ্ছের খাভরা আরই পার্ক প্রথম অবকাঠামো প্রকল্প নয় যেখানে আদানি গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি অংশীদারিত্ব পেয়েছে।
আদানি গোষ্ঠী ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বন্দর, মুন্দ্রা বন্দরের উন্নয়ন এবং পরিচালনা করছে।
মুন্দ্রা বন্দরের কাছেই রয়েছে আদানির স্পেশাল ইকনমিক জোন বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে বিভিন্ন জিনিস উৎপাদনকারী বেশ কয়েকটি ইউনিট রয়েছে।
আদানি টুনা টার্মিনালেরও পরিচালনা করে, যা দীনদয়াল পোর্ট ট্রাস্টের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। বৃহত্তম পাবলিক সেক্টর বন্দর, কচ্ছের কান্ডলা বন্দর দীনদয়াল পোর্ট ট্রাস্টের আওতাধীন।
কচ্ছের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল জিকে জেনারেল হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করে আদানি গোষ্ঠী।
২০০১ সালের ভূমিকম্পের পর এই হাসপাতালটি তৈরি করে সরকার। ২০০৯ সালে 'পিপিপি মডেলের' (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) ভিত্তিতে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে একটি মেডিকেল কলেজ তৈরি করে আদানি গোষ্ঠী।
শুধু তাই নয়, ২০১১ সালে আদানি গোষ্ঠী বিট্টা গ্রামে একটি ৪০ মেগাওয়াট সোলার পার্কও স্থাপন করেছিল, যা মহাবিপন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত পাখি, 'গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড'-এর আবাসস্থলের কাছাকাছি অবস্থিত।
নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin
কমেন্ট বক্স