রমজান আত্মশুদ্ধি, সংযম ও ভ্রাতৃত্বের মাস। ইসলামের অন্যতম শিক্ষা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা। ইফতার মাহফিল সেই সংযোগের একটি মাধ্যম হতে পারত, যেখানে সবাই একত্রিত হয়ে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতেন। কিন্তু বাস্তবে ইফতার অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় পবিত্রতা ছাপিয়ে রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থসিদ্ধির একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রমজান এলেই রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ইফতার আয়োজনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কেউ জনসংযোগ বাড়াতে, কেউ রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে, কেউবা নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে এসব আয়োজন করে। দলীয় বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেখানে ভিন্ন মতাদর্শীদের জন্য কোনো জায়গা থাকে না।
ইফতার মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত রোজাদারদের একত্রিত করে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বাড়ানো। অথচ, বড় বড় পাঁচতারকা হোটেল বা বিলাসবহুল কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত ইফতার পার্টিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকে না। এসব মাহফিলে দলের শীর্ষ নেতা, ব্যবসায়ী, আমলা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সমাগম ঘটে। এতে সাধারণ রোজাদারদের ইফতারের চেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের খুশি করাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
সাধারণ মানুষ যখন রমজানের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কষ্ট পাচ্ছে, তখন রাজনৈতিক মহল ইফতারে বাহুল্য প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। ইফতারে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করা হয়, অথচ দরিদ্রদের জন্য সহায়তা অপ্রতুল। এসব আয়োজন কি প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় মূল্যবোধের অংশ, নাকি প্রচারের নতুন কৌশল?
ইসলামে ইফতার মাহফিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং দানশীলতা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করায়, সে তার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।" অথচ, এখন অনেক ইফতার মাহফিল লোক দেখানো ও অহংকার প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। রোজাদারদের জন্য সাধারণ খাবার, অথচ অতিথিদের জন্য বিরিয়ানি, কাবাব, নানা রকম বিদেশি খাবার—এটা কি ইসলামের শিক্ষা?
ইফতার মাহফিলকে প্রকৃত অর্থে কল্যাণকর করতে হবে। প্রথমত, ইফতার আয়োজন যেন দলীয় স্বার্থের চেয়ে মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয়। দ্বিতীয়ত, ইফতার শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের জন্য নয়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্যও ব্যবস্থা করা উচিত। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত একে অপরকে দাওয়াত দিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করা। চতুর্থত, বিলাসিতার নামে অপচয় বন্ধ করতে হবে, যা ইসলামের শিক্ষা ও মানবিকতার পরিপন্থী।
ইফতার মাহফিল হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করার মাধ্যম। এটি যেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, অভিজাত শ্রেণির ভোজন বিলাসিতা বা দলের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে না দাঁড়ায়। রমজানের শিক্ষা যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে ইফতার মাহফিলকে প্রকৃত অর্থে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব। অন্যথায়, এটি শুধুই স্বার্থান্বেষণের আরেকটি মুখোশ হয়ে থাকবে।
লেখকঃ মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ (বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সম্পাদক, দৈনিক মাতৃভূমির খবর)