ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ , ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ হলে আসল পরিস্থিতি জানা যাবে

দৈনিক মার্তৃভূমির খবর
আপলোড সময় : ০২-১১-২০২৪ ১১:০২:২৩ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ০২-১১-২০২৪ ১১:০২:২৩ পূর্বাহ্ন
অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ হলে আসল পরিস্থিতি জানা যাবে
নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। এর শ্বেতপত্র প্রকাশ হলে পূর্ণচিত্র প্রকাশ পাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়িক সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এবং বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান।

দ্য কাপনা টি কোম্পানি লিমিটেড এবং পূবালী জুট মিলসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরান অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (এসিআই) এবং এর সহযোগী কোম্পানির স্বাধীন পরিচালক।

বর্তমানে ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সামিউর রহমান সাজ্জাদ।

কামরান টি রহমান: আমরা একটি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। গত দেড় দশকে অনেক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা হয়েছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে এক সময় ১৪ শতাংশ হয়, যদিও ইদানীং একটু কমেছে।

দেশীয় ঋণ, বিদেশি ঋণ উভয়ই অনেক বেড়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থপাচার হয়েছে, যা ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে। যত তাড়াতাড়ি এটা করা যাবে ততই মঙ্গল। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক কমে গিয়েছিল। মার্কিন ডলারের দাম ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে খোলাবাজারে ১৩০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল, যা এখন ১১৫ টাকা। এটি পুরো অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে।

সরকার একটি শ্বেতপত্র কমিটি তৈরি করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য অর্থনীতির মূল চিত্র, বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় থাকবে। আশা করছি দ্রুতই এ তথ্য আমরা পাবো।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ কিছু সংস্থা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ৪ শতাংশ বলেছে, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বলেছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে হয়তো আমরা কিছু অর্থ বাজেট সহায়তা হিসেবে পাবো।

দেশের ব্যাংকখাত মন্দ ঋণের ভারে ভীষণ খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। কর ও রাজস্ব সংগ্রহ ৮ থেকে ৯ শতাংশ মাত্র, যা কেবল দক্ষিণ এশিয়ায়ই নয়, সারা বিশ্বের তুলনায় অনেক কম। তবে আশার কথা হলো আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ছে এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পজিটিভ।

আমাদের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। নিজেদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের আশায় লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হচ্ছে। এছাড়া অদক্ষতার কারণে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সও অনেক কম।

সরকার একটি শ্বেতপত্র কমিটি তৈরি করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য অর্থনীতির মূল চিত্র, বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় থাকবে। আশা করছি দ্রুতই এ তথ্য আমরা পাবো।

কামরান টি রহমান: এখন তো আমাদের প্রধান সমস্যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ শক্ত না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। অনেকে কাজে যোগদান করেননি। যারা যোগদান করেছেন তারাও ঠিকমতো কাজ করছেন না। এটি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতির অনেক কিছুই ঠিক থাকবে না।

আমার মনে হয় তাৎক্ষণিক উদ্যোগ হিসেবে স্বাধীনতার পর যেভাবে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামরিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবে নিয়োগ দিয়ে পুলিশের স্বল্পতা পূরণ করা উচিত।

জাগো নিউজ: আপনি চা এবং পাটশিল্পের একজন সফল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশে এ শিল্পের প্রসারে মূল বাধা কী এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?

কামরান টি রহমান: আসলে চা শিল্পের মূল সমস্যা কম মূল্য। আমরা কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। পাঁচ বছর ধরে দাম নিম্নমুখী। শিল্প উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করছি। সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের ১২টি বাগান বন্ধ হয়ে গেছে লোকসান গুনতে গুনতে। এসব বাগানে যারা কাজ করতেন তারা পেশা পরিবর্তন করতে পারবেন না।

২০২২ সালে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দীর্ঘ ১৯ দিন পুরো শিল্প বন্ধ ছিল। ফলে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল, যা এখনো আমরা পুষিয়ে উঠতে পারিনি। শ্রমিকদের মজুরি প্রায় ৪২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করা হয়েছিল। সবাই শুধু অর্থ দিয়ে পরিমাপ করে। চা-শ্রমিকদের বেতনের পাশাপাশি আরও অনেক সুবিধা দেওয়া হয়, তা নিয়ে কেউ কথা বলে না।

পাটের অবস্থা তো অনেক আগে থেকেই শোচনীয়। পাটের ব্যাগ ব্যবহার আইন করা হয়েছিল শিল্পের প্রসারের জন্য। কিন্তু তার কোনো প্রয়োগ হয়নি। পাশাপাশি দিন দিন রপ্তানিও কমছে। পলিথিন ব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করলে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাড়বে না।

এই চাপ সম্পূর্ণ চা বাগানের মালিকদের ঘাড়ে পড়েছে, যদিও আমাদের লাভ খুবই সীমিত। আমাদের একটি হিসাব মতে,১০ টাকার এক কাপ চা বানাতে মাত্র ৪২ পয়সা খরচ হয় চা পাতা কিনতে। বাকি টাকাই খরচ হয় চিনি, পানি, জ্বালানি, ভাড়াসহ অন্য জায়গায়। তাহলে চাপে কেবল আমরাই আছি।

স্বাধীনতার পর আমাদের চা উৎপাদন ছিল তিন কোটি কেজি, যা বর্তমানে ১০ দশমিক ৩ কোটি কেজিতে উন্নীত হয়েছে। আমাদের চা শিল্পে দেশীয় চাহিদা ৯ দশমিক ৫ কোটি কেজি। অর্থাৎ আমরা চাহিদার বেশি চা উৎপাদন করছি। ফলে দাম কমে যাচ্ছে। আমরা চা রপ্তানি করতে চাই। এজন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

পাটের অবস্থা তো অনেক আগে থেকেই শোচনীয়। পাটের ব্যাগ ব্যবহার আইন করা হয়েছিল শিল্পের প্রসারের জন্য। কিন্তু তার কোনো প্রয়োগ হয়নি। পাশাপাশি দিন দিন রপ্তানিও কমছে। পলিথিন ব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করলে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাড়বে না।

ভারতে ১৯৮৭ সালে এই আইনের প্রয়োগ করার কারণে সেখানকার সব পাটকল ভালোভাবেই চলছে। আমাদের দেশে এই আইনের শক্ত প্রয়োগ ঘটলে এ শিল্প টিকে যাবে।


কামরান টি রহমান: বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়াতে হবে, নয়তো তারা বিনিয়োগ করার আত্মবিশ্বাস পাবে কীভাবে? বিদেশি বিনিয়োগ তখনই আসবে যখন তারা দেখবে যে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বিনিয়োগ করছেন।

এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবস্থা ভালো নয়। শিল্প এলাকায় গ্যাসের প্রেশার অনেক কম। অনেকে সিএনজি, এলপিজি দিয়ে কাজ চালাচ্ছে, যা অনেক বেশি ব্যয়বহুল।

বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুযায়ী আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ২০৩০ সালে শেষ হয়ে যাবে। যদি নতুন গ্যাসকূপের সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে কারখানায় গ্যাসের চাপ আরও কমে যাবে, ফলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটবে।

সরকারের উচিত নতুন গ্যাসকূপের সন্ধান করা। কিছু কাজ চলমান, তবে তা যথেষ্ট নয়। শিগগির এ কার্যক্রম পাঁচগুণ বাড়াতে হবে, অন্যথায় বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।

কামরান টি রহমান: আর্থিকখাত বিভিন্ন কারণে দুর্বল হয়েছে। আমাদের ঋণের বোঝা কমাতে হলে দুর্নীতি খুঁজে বের করে তা নির্মূল করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি কমাতে হবে, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দক্ষতা বাড়ানোর দিকে ফোকাস করতে হবে।

এছাড়া অর্থনৈতিক তথ্যের নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যে তা সঠিক কি না। সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। আশা করছি শ্বেতপত্রে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।


কামরান টি রহমান: এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন টাস্কফোর্স গঠন করেছে। যারা নিয়মিত ব্যক্তিখাতের বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছে। সেখানে অর্থনীতিবিদ, শিল্প, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেক হোল্ডারের উপস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে।

জাগো নিউজ: এমসিসিআই সেপ্টেম্বর মাসের পিএমআই ইনডেক্স প্রতিবেদন অনুযায়ী অর্থনীতি আগস্টের তুলনায় ভালো করলেও এখনো চাপের মধ্যে আছে। সমাধান কি?

কামরান টি রহমান: অর্থনীতি আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে সামান্য ভালো করলেও এখনো চাপের মধ্যে আছে, তবে ট্রেন্ড পজিটিভ। সংস্কার হচ্ছে, শ্বেতপত্র প্রকাশ হলে আসল পরিস্থিতি জানা যাবে। তবে সেজন্য সময় লাগবে।

কামরান টি রহমান: এই সাক্ষাৎকারে আমরা যে সব বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করলে অর্থনীতি ভালো করবে। অর্থনীতি কোথায় ছিল, আছে এবং যেতে চায় তা নির্ভর করবে সংস্কারের ওপর।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ