ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

শিশুর মনস্তত্ত্বের বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠন: ২-৬ বছর বয়সে বিজ্ঞান ও ইসলামিক নির্দেশনা

সুখী ও সফল আগামীর জন্য প্যারেন্টিং গাইড (পর্ব – ২)

মার্তৃভূমির খবর ডিজিটাল ডেস্ক
আপলোড সময় : ২৬-১০-২০২৪ ১১:০৩:০৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৬-১০-২০২৪ ১১:০৯:৫১ অপরাহ্ন
সুখী ও সফল আগামীর জন্য প্যারেন্টিং গাইড (পর্ব – ২) প্রতীকী ছবি

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ: শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক বছরকে তার শারীরিক, মানসিক ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে ধরা হয়। ২-৬ বছর বয়সের সময়কালে শিশুরা দ্রুত শিখতে ও বিকশিত হতে থাকে। এই সময়ে তাদের মস্তিষ্কের প্রায় ৯০% বিকাশ সম্পূর্ণ হয় এবং তাদের বিভিন্ন গুণাবলির ভিত্তি স্থাপিত হয়। পিতামাতার সঠিক দিকনির্দেশনা এবং যত্ন এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে এই সময়ের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।


প্রাথমিক বিকাশের সময়ের গুরুত্ব
শিশুর জীবনের এই পর্যায়ে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ অত্যন্ত দ্রুত ঘটে। তারা নতুন ভাষা শিখতে শুরু করে, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া রপ্ত করে এবং তাদের চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং বিকাশ এই সময়ে তীব্রতর হয়, যা তাদের ভবিষ্যতের শিক্ষাগত ও ব্যক্তিগত দক্ষতায় বড় ভূমিকা রাখে।
 

কুরআনের নির্দেশনা: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, "তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের শরীরকে সুন্দর করেছেন" (সুরা তাগাবুন, ৬৪:৩)। এই আয়াতটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের গুরুত্বকে তুলে ধরে এবং আমাদেরকে শারীরিক সুস্থতা ও বিকাশের প্রতি যত্নবান হতে নির্দেশ দেয়।
গবেষণা অনুযায়ী, শিশুরা এই সময়ে যেসব দক্ষতা আয়ত্ত করে, তার ভিত্তিতে তারা পরবর্তী জীবনে বড় বড় শিক্ষাগত লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। সুতরাং, পিতামাতার উচিত এ সময়ে তাদের শিশুদের বিকাশের দিকে বিশেষ নজর দেয়া এবং তাদের শেখার প্রক্রিয়াকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা।


শারীরিক বিকাশ: বিজ্ঞান ও কুরআনের নির্দেশনা
শিশুর শারীরিক বিকাশ হল এই বয়সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। ২-৬ বছর বয়সে শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ ঘটে, এবং মোটর স্কিলগুলোও পরিপূর্ণ হতে থাকে। এই সময়ে শিশুরা দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা, এবং অন্যান্য শারীরিক কাজের মাধ্যমে শক্তি এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়। এই সময়ে পিতামাতার উচিত শিশুদের খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করে দেয়া, যাতে তারা নিজেদের শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে।
 

হাদিসের নির্দেশনা: হাদিসে এসেছে, "তোমাদের সন্তানেরা যখন সাত বছর বয়সে পৌঁছায়, তখন তাদের নামাজের জন্য নির্দেশ দাও" (আবু দাউদ)। এই হাদিসে ছোটবেলা থেকেই শারীরিক ও আত্মিক বিকাশের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। শিশুদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি তাদের মননশীলতার বিকাশেরও প্রয়োজন রয়েছে, যা ভবিষ্যতে তাদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
 

মানসিক বিকাশ: স্মৃতি ও চিন্তাধারার বিকাশ
শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্মৃতি এবং চিন্তাধারার বিকাশ অপরিহার্য। ২-৬ বছর বয়সে শিশুদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত কার্যকরী হয় এবং এই সময় তারা নতুন ভাষা শিখতে ও জ্ঞানগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
গবেষণায় দেখা যায় যে এই বয়সে শিশুরা তাদের স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। এই বয়সে মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে, যার মাধ্যমে শিশুদের শেখার ক্ষমতা ত্বরান্বিত হয়। নতুন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান শিখে তারা দ্রুত নতুন তথ্য আয়ত্ত করতে পারে।
 

হাদিসের প্রাসঙ্গিকতা: হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, "প্রত্যেক শিশুই ফিতরাত (স্বাভাবিক গুণাবলি) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এরপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজক করে তোলে" (সহিহ মুসলিম)। এই হাদিসে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং পিতামাতার দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রাথমিক শিক্ষা এবং পারিবারিক পরিবেশ অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
 

সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ: ব্যক্তিত্ব গঠনের সূচনা
শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২-৬ বছর বয়সে, যখন তারা নতুন আবেগ এবং অনুভূতির মুখোমুখি হতে শুরু করে। এই সময়ে তারা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া শিখতে শুরু করে এবং পরিবার, বন্ধু এবং অন্য শিশুদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
এই বয়সে শিশুদের মধ্যে নতুন আবেগ যেমন রাগ, দুঃখ, আনন্দ ইত্যাদি বিকশিত হয়, এবং তাদেরকে এগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতে শেখানো গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতার সহায়ক ভূমিকা শিশুর আবেগীয় বিকাশে বড় প্রভাব ফেলে, এবং শিশুরা শিখতে পারে কীভাবে তারা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেগুলিকে প্রকাশ করবে।
 

কুরআনের নির্দেশনা: পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তোমরা নিজেদের এবং পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা কর (সুরা আত-তাহরিম, ৬৬:৬)। পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে এই নির্দেশনায় বোঝানো হয়েছে, শিশুদের সঠিক সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ নিশ্চিত করা পিতামাতার দায়িত্ব।
 

ব্যক্তিত্ব গঠন: স্বনির্ভরতা ও সৃজনশীলতা
শিশুরা ৫-৬ বছর বয়সে জটিল সমস্যার সমাধান করতে এবং বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাধারা গড়ে তুলতে শুরু করে। তাদের সৃজনশীলতা বাড়াতে এবং স্বনির্ভরতা তৈরি করতে পিতামাতার সহায়ক ভূমিকা অপরিহার্য। সৃজনশীল খেলার মাধ্যমে শিশুরা নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করতে শিখে এবং নিজেদের মধ্যে স্বনির্ভরতার ভিত্তি তৈরি করে।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সৃজনশীল খেলাধুলা এবং নতুন ধারণার সাথে যুক্ত হওয়া শিশুর মেধার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পিতামাতার উচিত এই সময়ে শিশুর সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা এবং তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখানো।
 

প্যারেন্টিং কৌশল: বিজ্ঞান ও কুরআনের নির্দেশনা
২-৬ বছর বয়সে শিশুর সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য পিতামাতার কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নিচে কিছু প্যারেন্টিং কৌশল উল্লেখ করা হলো:

  1. ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি: শিশুদের বিকাশের জন্য একটি সহযোগিতামূলক ও সহানুভূতিশীল পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের পরিবেশ শিশুর মানসিক এবং আবেগীয় বিকাশে প্রভাব ফেলে। একটি সমর্থনময় পরিবেশ শিশুকে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত বোধ করতে সহায়ক হয়।
  2. শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপ: শিশুদের নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত। খেলাধুলা, সৃজনশীল কাজ এবং শিক্ষামূলক কার্যকলাপ তাদের শারীরিক এবং মানসিক শক্তি বাড়াতে সহায়ক হয়।
  3. ধৈর্য ও মনোযোগ বৃদ্ধি: শিশুদের মধ্যে ধৈর্য এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করতে তাদের বিভিন্ন শিক্ষামূলক এবং সৃজনশীল কার্যকলাপে যুক্ত করতে হবে। তাদের সাথে নিয়মিত আলোচনা করা এবং তাদের চিন্তাভাবনা শোনার মাধ্যমে তাদের মনোযোগ এবং ধৈর্য বাড়ানো যায়।

 

শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আবেগীয় বিকাশের জন্য ২-৬ বছর বয়স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতার সঠিক নির্দেশনা এবং যত্নের মাধ্যমে শিশুরা এই সময় তাদের জীবনের ভিত্তি তৈরি করে। কুরআন এবং হাদিসের নির্দেশনা এবং আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা অনুসারে, পিতামাতারা শিশুদের বিকাশের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। এই সময়ের অভিজ্ঞতা এবং শেখা শিশুদের ভবিষ্যতের শিক্ষাগত এবং সামাজিক সফলতায় বড় ভূমিকা রাখে।
 


নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ