ঢাকা , শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪ , ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

পুনর্লিখনে সংবিধান হোক জনবান্ধব

দৈনিক মার্তৃভূমির খবর
আপলোড সময় : ০৮-০৯-২০২৪ ১২:৩৮:৩৬ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৮-০৯-২০২৪ ১২:৩৮:৩৬ অপরাহ্ন
পুনর্লিখনে সংবিধান হোক জনবান্ধব
এই জটিল ও ক্রসকারেন্টে ভরপুর রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রপঞ্চ নিয়ে চিন্তক সমাজে তেমন কোনো নড়াচড়া নেই। যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং যারা সংবিধান নাড়াচাড়া করে প্রজ্ঞাধিপতি হয়েছেন, তারা বেশ তৎপর। সাধারণত সমাজের সচল চিন্তকদের মধ্যে একধরনের সচেতনতা আছে যা রিঅ্যাকশন হিসেবে আমরা দেখতে পাই। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি, কর্মপরিধির মধ্যে যে কোনো বিষয় সম্পর্কে রয়েছে আমাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞান, অভিজ্ঞতা।

এবং আমরা জানি সাংবিধানিক জটিলতার প্যাচগুলো বেশ কন্ট্রাডিকটরি ও রসালো বা পিচ্ছিল। এমন ভাষায় ওই বিষয়টি প্রণেতাগণ লিপিবদ্ধ করেছেন, যাতে সাধারণ শিক্ষিত লোকজন তার ত্রুটি-বিচ্যুতি, ও রচয়িতাদের অভিসন্ধি বুঝতে না পারেন। এবং সেই সব রাজনৈতিক চিন্তার প্যাচ খোলা সহজ নয়। এর কারণ আমাদের রাজনৈতিক শিক্ষা ঔপনিবেশিক বিধান, রাজনীতিকগণ এই পিচ্ছিল টানেলে নিজেদের জ্ঞানকে ঢুকিয়ে দিয়ে একরকম প্রজ্ঞার ভঙ ধরে বসে আছেন।

 মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের, আমার বাবার সম্পত্তি নয়। এই যেটা ১৯৭১ সালে স্বাধীন করেছে দেশের আপামর জনগণ, কোনো একক ব্যক্তি নয়। তবে, রাজনৈতিকদের অবদান স্মরণ রাখতে হবে। 

আমাদের সংবিধানটিকে এতোকাল মহান বলে জ্ঞান দেয়া হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এই সংবিধান জনগণের অধিকার দিয়েও তা আবার হরণ করে রেখেছে ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। এই রকম হরণের আরো বহু উদাহরণ দিতে পারবেন আমাদের চিন্তাশীল মানুষেরা, যাদের কেউ কেউ এখন সংবিধানটিকে পুনরায় লেখার কথা বলছেন।

গত ৫০ বছর ধরেই কমবেশি সংবিধানের ত্রুটি নিয়ে রাজনীতিকরা কথা বলেছেন। সংবিধানের নাগরিকের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু যারা ক্ষমতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ( এক তৃতীয়াংশ) থাকার পরও তারা ওই সব ত্রুটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেননি। কারণ তাদের ক্ষমতার স্বার্থ। এই অন্ধ স্বার্থপরতাকে কিভাবে আমরা নিঃস্বার্থপরতা দিয়ে উত্তরণের মহাসড়কে নিয়ে আসবো? যারা দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপরে কিছু ভাবতেই শেখেননি, তারা কি তা পারেন বা পারবেন?


এ-কারণে বলেছি সংবিধান এমন কিছু অপকর্ম দিয়ে বিধিবদ্ধ করেছেন সদ্য বিগত হাসিনার স্বৈরাচারি সরকার, যাকে আমরা অপরাধতুল্য বিবেচনা করতে চাই। তারা যা পরিবর্তন পরিবর্ধন, সংযোজন ও সংস্কার করেছেন তা মনে হয় যে কোনো অচিহ্নিত ক্যু-দেতার বিরুদ্ধে কিন্তু আসলে ওই সংস্কার যেন কেউ বাতিল না করতে পারে, তারও ফরমান সেখানে জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা মানুষের অধিকারহরণ।

এই রকম কুকর্মে রাজনীতিকদের বিদ্যাবুদ্ধি বেশ প্রখর ও প্রবল। শেখ হাসিনার আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের ক্রিমিনাল ব্রেন কাজ করেছে। তিনি এবং তার প্রশাসনিক অ্যালিগণ ওই সংবিধানের মৌলিকতাত্ব কেবল ধসিয়ে দেননি, জনগণকে বাদ রেখেছেন রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব থেকেও। জনগণে, ভোটার জনগণ যাতে ভোটের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ না হতে পারে, তাই তাদের সম্মানের লেজটাও কেটেছেন।

ঠিক এই কারণেই বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, এই সংবিধান পুনরায় না লিখলে আর এ দিয়ে কাজ চলবে না। কারণ ওই সংবিধান রাজফরমানের সামিল। আমরা জানি রাষ্ট্রের শিরদাঁড়া, ভিত ও স্থাপত্য সৌন্দর্য় নিহিত আছে বা থাকে ওই সংবিধানের পরতে পরতে। সেই স্থাপত্যকলা ধসিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা, যাতে ২০৪১ সাল পর্য়ন্ত আর কেউ ক্ষমতায় আসতে না পারে। এই সময়ের মধ্যে তিনি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা পঙ্গপালের মতো যা পারে ধ্বংস করে জাতির চিন্তার স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক শক্তি, ও জাতি বিনির্মাণে আকাঙ্খা চিরতরে হারিয়ে ফেলে। কেন তিনি এমনটা করেছেন?

বিশ্লষকগণ বলতে চান, তিনি দেশটিকে এমন এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছেন, যাতে আমরা সব সময় পরনির্ভরশীল হই। আর সেই পরনির্ভরশীলতার মামুর বাড়িটি দিল্লিতে। দিল্লির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অপছায়া আমাদের উপহার দিয়ে তিনি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে যাবেন, তবু জাতিকে শিক্ষা দিতে তিনি পিছপা হবেন না। এই জাতি ( পড়ুন, মিলিটারি ক্যু-দেতা )তার বাবা-মাসহ প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করেছে। মিলিটারিদের বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলতে পারেন না। কারণ, তাদের হাতে আছে অস্ত্র। ভয় এখানেই যে ওই মিলিটারি নামক দেশরক্ষাবাহিনীর ডিরেইলড কিছু সদস্য ওই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিলো। তাদের বিচার করেছেন তিনি ও তার সরকার। ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন অনেককে। আবার কাউকে কাউকে ধরতেই পারেননি। কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তিনি যে দেশটিকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, তার বহু উপাদান-উপকরণ (তথ্য-উপাত্ত) তিনি রেখে গেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার মসনদের রস তাকে আরো নগ্ন-নিষ্ঠুর হতে দিয়েছে, যাতে তাকে জাতির সামনে অপমানিত ও অপদস্ত হয়ে চোরের মতো পালাতে হয়। সংবিধান সেই উপাত্তের একটি।

সংবিধান পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পুনরায় লিখিত হতে পারে। এটা কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। তারপরও আমরা এই সংবিধানকে `পবিত্র’ তকমা পরিয়ে বিবেচনা বা ব্যবহার করি। আমরা যারা এটা করি, তা অন্ধদের কাজ। মূর্খ ও স্বার্থপরগণ অন্ধ ও অবিবেচক। তারাই সংবিধান পুনরায় লিখবার বিপক্ষে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সংবিধান পুনর্লিখিত ও সংস্কৃত হলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেই। সংবিধানের ভাষা হতে হবে সরল, যাতে সাধারণ শিক্ষিত লোকেরাও তা পড়ে বুঝতে পারে। মনে রাখতে হবে সংবিধান কোনো পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভ নয়।

বর্তমান সংবিধানটি রচিত হয়েছে ভারতের সংবিধানের আলোকে। কিন্তু যেখানে দলীয় স্বার্থ ও নেতার স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজন পড়েছে, সেখানে দেশের মালিক পক্ষ জনগণের অধিকারহরণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি সংবিধানের লেখকগণ। আর কে না জানে, শেখ মুজিবই ছিলেন সেই নেতা যিনি নিজের স্বার্থের বাইরে এক কদমও যাননি। তবে, তার কন্যা, শেখ হাসিনা বাবার রাজনৈতিক চেতনার চেয়ে শতগুণ নির্মম ও বর্বর। তিনি বলেন, আরও মানুষ হত্যার শিকার যাতে না হয়, সে কারণেই পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

গত ১৬/১৭ বছর ধরে হাজার হাজার মানুষকে গুম ও হত্যা করেছেন ( পড়ুন বিএনপির নেতা-কর্মী ও বিরুদ্ধ মতাদর্শী হত্যা করেছেন) আয়নাঘর সৃষ্টি করে সেই অপকর্ম করেছেন, যা জানতে পারলে জাতি তাকে প্রকাশ্যেই কবর দিতে কসুর করতো না। সেই নেতা বলেন তিনি নাকি হত্যা করে ক্ষমতায় থাকতে চাননি। তাঁর এই রকম অপরাধের পরও তিনি যে সশরীরে বেঁচে ভারতে আশ্রয় পেয়েছেন, সেটা কিভাবে হলো, তা আমরা বুঝতে পারছি না। ভারত হাসিনার মতো একজন খুনে স্বৈরাচারকে আশ্রয় দিয়ে দিল্লির মনোভাবই আমাদের বুঝিয়েছেন। দেশ দখলের চেয়ে এই আধুনিক যুগে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দখল করে পদানত করাই শ্রেয়তর।

বৈশ্বিক ও এশিয়ান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রপঞ্চ এমন জটিল ও কুটিল যে তার অন্তঃস্রোতের তল পাওয়া দুঃসাধ্য-প্রায়। এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে যে সংবিধানের রচয়িতাগণকে হতে হবে জনগণের প্রতিনিধি। এই যে একটি গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেলে হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরিয়ে, এবং অভ্যুত্থানকারীরাই এখন ক্ষমতায়, তারাই তো জনআকাঙ্খার নায়ক, মহানায়ক, জনপ্রতিনিধি।

একটি ঔপনিবেশিক চেতনার আলোকে রচিত সংবিধানও তারই স্ট্রাকচারাল আলোকে রচিত হতে হবে নতুন একটি রচনা। কেন ও ই পরিত্যক্ত-প্রায় সংবিধানের রচনাগত স্টাইল ও ভাষায় এবং জনগণের তথাকথিত ভোটে নির্বাচিত একদল অন্ধ রাজনৈতিক অনুকারীদের হাতে তৈরি হতে হবে সংবিধান? আমেরিকান জনগণ ১৭৭৬ সালো স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাদের সংবিধান রচিত হতে সময় লাগে মাত্র ১০ বছর। আর আমাদের সংবিধান রচিত হয়েছে ৯ মাসে। প্রতিভা কতো বেশি আমাদের। ৯ মাসে রচিত বলেই ভাবনা-চিন্তার কোনো সুযোগ পাননি আমাদের প্রণেতাগণ। পেলে এই রকম একটি ভুলে-ভরা ও স্বৈরাচারি আকাঙ্খাযুক্ত, জনগণের প্রতিনিধিদের দাসে পরিণত করার বিধান সংবলিত সংবিধান রচিত হতো না।

আমি মনে করি, সংবিধান পুনরায় লিখিত হলে ভালো হয়। জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে তা যে কোনো নাগরিকগণের হাতেই তাচিত হতে পারে। তার জন্য সংসদ সদস্য হতে হবে না। সংসদ কেবল ওই নতুন সংবিধান অনুমোদন দেবেন। তারপর জনগণের সামনে তার পাতাগুলো উন্মুক্ত করবেন। আমি জানি জনগণের বড় অংশই নিরক্ষর তারা পড়তে পারবেন না। গত ৫৩ বছরের রাজনৈতিক ও সামরিক সরকাগুলোর চিন্তায় এটা আসেনি যে দেশের বড় স্টেকহোল্ডার মানে মালিক জনগণকে তারা নিরক্ষরই রাখতে চান। কারণ তারা যদি ক্ষমতাসীন ও রাজনৈতিক দলগুলোর অপকর্ম বুঝতে পারে, তাহলে সমূহ বিপদ।

সংবিধান কোনো রাজনৈতিক দলের বাবার সম্পত্তি হবে না, এই গ্যারান্টি দিতে হবে। এবং সেই বিধানটি অলঙ্ঘনীয় হবে। নির্বাচন কমিশনের কমিশনারগণ জাতীয় নির্বাচনের সময় একই ব্যালটে বা ভিন্ন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে, যাতে নির্বাহী বিভাগের লোকবল হায়ার নিতে না হয়।

বিচার বিভাগের প্রধান বিচারপতি ও হাই ও অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারকদের সংসদ কর্তৃক নিয়োগ অনুমোদন করতে হবে। সংসদ সদস্যগণ অবশ্যই সত্যিকার আইন প্রণেতা হতে পারেন, তার জন্য তাদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কোনো আইনপ্রণেতা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মে নিয়োজিত থাকতে পারবে না। তবে, তারা উন্নয়ন কাজের তদারকি করবেন ও গোপন রিপোর্ট দেবেন সংস্দরর সংশ্লিষ্টদের কাছে। তারা যেন তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের না বলেন যে এখানে আমি ১৪২তলা হাইরাইজ বানাবো, ওয়াদা দিলাম। এই ধরনের আজগুবি ও তার এখতিয়ারভুক্ত কথা যাতে তারা না বলেন, সেটা সংবিধানেই লিখিত ও চর্চার নির্দেশ থাকতে হবে।

আইনপ্রণয়ন ব্যতিত তাদের কাজ হলো লাইব্রেরিওয়ার্ক করা। সরকার তার নিজস্ব লোকবলের অধীনে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করবেন। তাতে আমলাদের কামলা দেবার কাজ বাড়বে। প্রশাসনের সকল সেক্টরে লোকবল বাড়াতে হবে, যাতে কোনো শিক্ষিত বেকার না তাকে। বিভিন্ন সেক্টরে জব ক্রিঠের মাধ্যমে যে পরিমাণ লোক লাগবে, সেই পরিমাণ ছাত্রই কেবল সেই সুযোগ পাবে। বাকিরা, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের কাজে নিয়োগ পাবেন।
এ-সব ছাড়াও আরো সুযোগ সৃষ্টি করে সরকারকে জনবান্ধব হতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের, আমার বাবার সম্পত্তি নয়। এই যেটা ১৯৭১ সালে স্বাধীন করেছে দেশের আপামর জনগণ, কোনো একক ব্যক্তি নয়। তবে, রাজনৈতিকদের অবদান স্মরণ রাখতে হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ