ঢাকা ০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
রোজা মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত করে-লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল। গজারিয়া বালুয়াকান্দি ইউনিয়নে সিকদার পরিবারে আমিরুল ইসলাম এর সর্মথনে আলোচনা সভা ও ইফতার দোয়া মাহফিল চসিকের ৬ ষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের ৩৮ তম সাধারণ সভায় মশা কমাতে কার্যক্রম বাড়াবে : মেয়র রেজাউল “বিড়ি শিল্পে ট্যাক্স প্রত্যাহারসহ চার দাবিতে রংপুর শ্রমিকদের মানববন্ধন” ইন্দুরকানী প্রেসক্লাবে ইফতার মাহফিল বরিশাল চকবাজার এবায়দুল্লাহ মসজিদে অগ্নিকান্ড। টাঙ্গাইলে দৈনিক সকালের সময় পত্রিকার পাঠক ফোরাম গঠিত চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই চক্রের ৫ সদস্য গ্রেপ্তার চট্টগ্রামে জালনোটসহ প্রতারকচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ রমজান মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘন করছে নারায়ণগঞ্জ চিশতিয়া বাউল সমিত

স্বপ্নই ছাই যার —– খোরশেদ আলম বিপ্লব

সবে মাত্র গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো সময় অতিবাহিত হলো, সেই কবে বছর ছয়েক আগে পদার্পণ করেছিল এই রাজশাহী শহরে। চাঁদপুর জেলার অতি নিকটতম থানা মতলবে শিমুলের জন্ম। অন্যান্য চারজনের মতো এইচএসসি টাও সম্পন্ন করল মতলবেই। প্রথমে ইচ্ছে ছিলো ঢাকাতেই পড়াশুনা করার। কিন্তু বাঁধ সাদলো কমপিটিশন আর মজবুত আর্থিক খুঁটি। যার অভাবে প্রাথমিক কমপিটিশনে সফল হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার স্বপ্ন মুছে গেলো। অবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে (অনার্স) পড়ার সুযোগ হলো। তারপর এক এক করে ৬টি বছর কেটে গেলো হোস্টেলের ডালভাত খেয়ে। রাতে একটুও ঘুমাতে পারেনা। বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ এর মধ্যদিয়ে রাত পার করে দিল। সকাল হতে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হল। সারাদিন এই শহরের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বাসায় ফিরতে শিমুলের বিলম্ব হয়ে গেলো। এর মধ্যে ট্রেনের টিকিট কনফার্ম করা হয়েছে, আগামীকাল বিকাল ৫টায় ট্রেন। শিমুল মনে মনে স্থির করলো ঢাকায় এসে প্রথমে মিরপুরে খালার বাসায় উঠবে, সেখানে ২/১ দিন থেকে বাড়ি যাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছ-গাছ করা শেষ। আজ রাতেই রুমমেট জসীম ও আলমগীর এতদিনের বন্ধন ছেড়ে চলে যাবে এজন্য মনটা কিছুটা হলেও খারাপ। কিন্তু যেতে তো হবেই। যে যাবে তাকে তো বেঁধে রাখা যাবে না। সেতো কর্তব্যের টানেই আপনজনের কাছে যেতে চায়। বন্ধুদের ৯টার গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরতে ১০টা বেজে গেলো। শূন্য বিছানায় খানিকটা গা এলিয়ে দিল। খাওয়া দাওয়ার পর্বটা তিনবন্ধু মিলে রেস্টুরেন্টে সেরে এসেছে। হাতমুখ ধুয়ে সোজা খাটের উপরে। সারা দিনের ঘুরাঘুরিতে দু’চোখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। কিছুক্ষণের মধ্যে নিদ্রাদেবীরকোলে ঢলে পড়লো শিমুল। হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে শিমুল স্বপ্ন দেখতে লাগলো। “ব্যগ কাধে করে বিকাল পৌনে ৫টার মধ্যেই হাজির হলো ট্রেন স্টেশনে। টিকিট আগ থেকেই বুকিং করা ছিল, তাই সিট পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। জানালার পাশে শিমুলের সিট। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। দুইবন্ধু বিদায় অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল। ঠিক পাঁচটা বাজতে ট্রেন ছেড়ে দিলো। শিমুল নীরবে বসে এই শহরের স্মৃতি নিয়ে ভাবতে লাগল। এ ভাবনার মাঝে আড়াই ঘণ্টা কেটে গেলো। তাঁর খানিকটা পরে আব্দুল্লাহপুর ষ্টেশন। সেখানে এসে ট্রেন থামল। জানালার পাশে বসে হকার্সদের আত্মচিৎকারে ঘোর কেটে গেলো শিমুলের। সে আগে বহুবার বন্ধুদের কাছে শুনেছে যে কিছু কিছু স্টেশনে যাত্রীদের জিনিসপত্র চুরি হয়। তাই নিজের ব্যগগুলোর প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রেখেছে। শিমুল যে সিটে বসা তা থেকে ৬০-৭০ গজ দুরে স্টেশন অফিস’র দক্ষিণ পাশে একটা গাছ। গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক তাঁর চোখে পড়ল। মাথার চুল এলোমেলো মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে জড়ানো ময়লা চাদর। লোকটার চোখে চখহ পরতেই সে দেখল তাঁর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে। শিমুলের মনে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হলো। ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিলো। শিমুল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো লোকটি এখনও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। খানিক পরেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রেল লাইনের দু’পাশে ঘন গাছ গাছালীতে আবছা অন্ধকার মনে হচ্ছে। ট্রেনটি আরও কিছুক্ষণ চলতে লাগলো। হঠাৎ ট্রেনটি ষ্টেশনবিহীন স্থানে থেমে গেল। কেন থামলো যাত্রীদের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিল। অবশেষে জানা গেল ট্রেনের মেশিন খারাপ হয়েছে তা সারতে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। হঠাৎ শিমুলের মনে হলো তাঁর এক বন্ধু বলেছিল মাঝে মাঝে এভাবে ট্রেন থামিয়ে ডাকাতি হয়। একথা মনে পড়তেই ভয়ের সঞ্চার হলো মনে। হঠাৎ শিমুলের চোখে পড়লো বেশ কিছু লোক ট্রেন থেকে নেমে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা বাজে। ব্যগটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। চারদিকে ঘোর অন্ধকার রাস্তা বুঝার উপায় নেই। পথিমধ্যে সহযাত্রী একজনের কাছে জানতে পারলো খানিকটা সামনে পাকা রাস্তা সেখানে ঢাকাগামী গাড়ি পাওয়া যাবে। একাকি হাটতে লাগলো সামনে, কিছুক্ষণ পর রাস্তার দেখা পেল। কয়েকবার হাত উচিয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। ভাবতে লাগলো এখন কি করা যায়। তাৎক্ষনিক চোখে পড়ল রাস্তা থেকে সোজা পূর্বদিকে একটা বাতির আলো দেখা যায়। মনে মনে ভাবল এখানে কোন লোকালয় হবে। এই ভেবে খানিকটা এগিয়ে গেলো। রাস্তা থেকে একটু নিচে, সমতল ভুমি হতে একটু উচু, সরু রাস্তা দিয়ে সামনের দিকে হাটতে লাগলো। কিছুক্ষণ হাটার পর সামনে একটা বাড়ি দেখতে পেল। সরু রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে হাটতে গিয়ে কয়েক বার হোঁচট খেয়েছে। চারদিক খোলা জায়গা মাঝখানে বাড়িটি নীরব নিস্তব্দ মুনে হয়। বাড়িটির এক কোণে একটা বাতি, যার আলোতে ছোট উঠোনটি পেরিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই। দুটি ঘরের মধ্যে কেউনা কেউতো নিশ্চয়ই থাকে। এই ভেবে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। এই মুহূর্তে নিজেকে কেন যেন অসহায় চোরের মতো মনে হচ্ছে। হঠাৎ শিমুলের কানে গুণ গুণ আওয়াজ ভেসে এলো। খানিকটা এগিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে শিমুল বুঝতে পারল ঘরের ভিতরে কেউ বই পড়ছে। পড়ার মৃদু শব্দ কানের দ্বার পর্যন্ত পৌছামাত্র মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকে কিছুটা সাহস নিয়ে গলা কাঁশির শব্দ করে উঠল। কোন সাড়া শব্দ নেই। দ্বিতীয়বার শব্দ করতেই ভিতর পড়ার শব্দ থেমে গেলো। শিমুল বাহির থেকে জিজ্ঞাসা করল- -কেউ কি বাড়িতে আছেন? ভিতর থেকে কোন সাড়া শব্দ এলোনা। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করল, “প্লিজ ঘরের ভিতর কেউ কি আছেন? এবার স্পষ্ট ভাষায় একটা মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে আসলো- -বাড়িতে কেউ নেই। হঠাৎ পাশের রুম থেকে কে যেন বলে উঠল- বাহিরে কে কথা বলছেরে মা? -শিমুল বলল- “প্লিজ দরজাটা একটু খুলবেন?” কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলে ভিতর থেকে অর্ধ বয়সী একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করল- -আপনি কোথা থেকে এসেছেন এবং কাকে চান? -দেখুন আমি রাজশাহী থেকে ট্রেনে এসেছি, এবং যাব ঢাকা। পথিমধ্যে ট্রেনের মেশিন খারাপ হওয়াতে বিলম্ব হচ্ছিল তাঁর উপর কিচ্ছুক্ষণ আগে ট্রেনে ডাকাতি হয়েছে। আমি ব্যপারটা আগে বুঝতে পেরে ডাকাত দল ট্রেনে পৌছার আগেই চলে এসেছি রাস্তায় কিছুদুর আসার পর ডাকাত ডাকাত চিৎকার শুনতে পেওে বুঝতে পারলাম অঘটন ঘটেছে। এমতাবস্থায় এতরাতে কোথায় যাব বুঝতে পারছিনা, তাই অন্তত আজকের রাতটা যদি আপনাদের এখানে থাকতে দিতেন। শিমুলের কথা শুনে এবার মহিলাটি বলল- -দেখুন আমাদের বাড়িতে কোন পুরুষ লোক নেই। এমতাবস্থায় আপনাকে…। কথাগুলো শেষ না হতেই শিমুল মনটা খারাপ করে হাটতে শুরু করল। ঘরের ভেতর থেকে একটি মেয়ে তার মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। হঠাৎ মহিলাটি পিছন থেকে ডাকলো- -শুনুন! – এত রাতে আপনি কোথায় যাবেন সেকথা কি ভেবেছেন? -না ভাবিনী। -ঠিক আছে আপনি ভিতরে আসুন। শিমুল এ মুহূর্তে যেন আনন্দের সাগরে ভেসে গেলো। সমস্ত ভয় আর ক্লান্তি কেটে আনন্দের ছোঁয়া লাগল মনে ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে ঢুকল। মেয়েটির চেহারা দেখে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে মায়ের সিদ্ধান্তে সে কিছুটা বিরক্ত এতরাতে অপরিচিত লোক…। -আসলে আপনাদের যে কি দিয়ে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছিনা। ভাববেন না, আমি সকাল হতেই চলে যাবো। নিজের ব্যগটা টেবিলের উপর রেখে পাশের খাটে গিয়ে বসল। মহিলাটি এবার শিমুলের পাশে বসে সমস্ত ঘটনা জানতে পারল। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন এ চলে এসেছে। -ঠিক আছে বাবা তুই হাত মুখ ধুয়ে এসো, আগে চারটা খাবে তাঁর পর তোমার সবকথা শুনতে পারব, আর হে এ আমার মেয়ে বৃথা। এবার আইএ পড়ছে। ওর বাবা তহসিল অফিসে চাকুরি করে অফিসের কাজে আজই বাহিরে গেছে। আর আমার একমাত্র ছেলে জয় একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকুরি করছে। বৃথার মা শিমুলের সাথে কথা বলে ভিতরের রুমে খাবার আনতে চলে গেলো। এদিকে বৃথা শিমুলকে নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে নিয়ে গেলো। শিমুল হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল। বৃথা এটা সেটা দিতে শিমুলের সামনে আসে। মেয়েটি কিছুটা লাজুক স্বভাবের দেখেই মনে হচ্ছে। শিমুলের খেতে খেতে বৃথার সাথে অনেক কথা হলো। অনেক কথার মাঝে হঠাৎ শিমুল বলল- -আমি তোমাদের খুব বিপদে ফেলে দিলাম তাইনা বৃথা? সত্যিই তোমাদের মতো মানুষ হয়না, তোমাদের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করলেও ঋণ শোধ হবেনা। -না না- তা কেন, আপনি এটাকে এভাবে দেখছেন কেন? বিপদ হয়েছে বলেই এখানে এসেছেন। যদি আপনি আজ এভাবে বিপদে না পড়তেন তাহলে এখানে আপনি আসতেনও না আর আমাদের সাথে পরিচয়ই হতনা। তাছাড়া বিপদতো কখন বলে আসেনা। কথা শেষ না হতেই বৃথা মায়ের নির্দেশে পাশের ঘরটিতে গেলো। ঐ ঘরটিতে বৃথার বড় ভাই থাকতো। আজ রাতে শিমুলকে ওখানেই থাকতে হবে। তাইতো বৃথা নিজ হাতে বিছানাপত্র গোছাতে লাগলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শিমুলের সাথে বৃথা ও তাঁর মায়ের অনেক কথা হলো। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইল বৃথাও। এবার পাশের রুম খুলে দিয়ে সেখানে শিমুল যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলো। শিমুল পাশের ঘরটিতে ঢুকে নিজের ব্যগ থেকে লুঙ্গি বের করে পরছিল এমন সময় বৃথা ভিতরে ঢুকল- শিমুল তড়িঘড়ি করে লুঙ্গিটা পড়ে নিল। বৃথা পানির জগ আর সাথে গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলল- -রাতে কোন সমস্যা হলে মাকে ডাকবেন। আমরা গরীব মানুষ। এই রাতটা না হয় আপনার একটু সমস্যা হবে। কিছু মনে না করলেই খুশি হবো” -দেখো বৃথা তোমরা আমার জন্য যা করলে তা হয়তো কেউ করবেনা। হঠাৎ মায়ের ডাক শুনে বৃথা শিমুলের শেষ কথাটুকু না শুনে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেলো। শিমুল দরজায় খিল দিয়ে খাটের উপর গাঁ এলিয়ে দিল। মা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। এদিকে বৃথা শিমুলকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠালো। সারারাত কীভাবে কেটে গেছে শিমুল টের পায়নি। হঠাৎ বৃথা শিমুলকে জিজ্ঞাসা করল- -রাতে ঘুম হয়নি বুঝি? -না-খুব ভালো ঘুম হয়েছে। আমি বুঝতেই পারিনি কখন ভোর হলো। বলেই শিমুল হেসে ওঠল, বিছানা থেকে ওঠে সোজা গোসল সেরে যাওয়ার জন্য তৈরি এমন সময় বৃথার মা ঘরে ঢুকল। -কি ব্যপার শিমুল এত তাড়াহুড়া করছ কেন? এখান থেকে দিনের বেলায় যেকোনো সময় গাড়ি পাওয়া যাবে। তাছাড়া আগে খাওয়া-দাওয়া করো তারপর না হয় চলেই যাবে। কথাগুলো বলেই বৃথার মা পাশের রুমে চলে গেল। এদিকে বৃথা নাস্তার প্লেট নিয়ে শিমুলের সামনে হাজির। শিমুল নাস্তা খাওয়ার ফাকে ফাকে বৃথার দিকে তাকাচ্ছে। বৃথা যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছেনা। এই মুহূর্তে শিমুল হঠাৎ বলল- – বৃথা তোমরা আমার জন্য যা করলে তা পৃথিবীতে আর কেউ করবে কি না আমি জানিনা। তবে তোমাদের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কথা বলতে বলতে শিমুল ভাল করে বৃথার মুখপানে তাকালো। চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো চোখগুলো কিঞ্চিৎ ফোলা সারারাত হয়ত মেয়েটি ঘুমায়নি। – কি ব্যপার বৃথা। সত্যি করে বলতো তুই কি সারারাত ঘুমাওনি? মাথা নিচু করে এবার বৃথা নিম্নস্বরে বলল- -আসলে সারারাত বারবার কেমন যেন আপনার কথা মনে হয়েছে। সত্যি মানুষের জীবন কত বিচিত্র তাইনা। কতভাবে কত মানুষের সাথে দেখা পরিচয় হয় আবার চলেও যায়। – সত্যিই আমি তোমাদের কাছে অপরাধী হয়ে গেল্ধাসঢ়;ম‌, যে তুমি আমার জন্য ঘুমাতে পর্যন্ত পারনি। সত্যিই আমি দুঃখিত। কিন্তু তোমাদের বাড়ি থাকা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। – আমি কিন্তু আপনার থাকা নিয়ে কিছু বলছিনা – তাহলে? (বিস্মিত হয়ে) – কেন যেন আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে আপনি আমাদের কত চেনা আত্মীয়। যখনই মায়ের মুখে শুনলাম এক্ষুণি চলে যাবেন, খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কেন যেন বুঝতে পারছি না। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। শিমুল এতক্ষণ মাথানিচু করে বৃথার কথাগুলো শুনছিল। মাথা উচু করে বৃথার দিকে তাকাল। বৃথার দু’চোখে জল দেখে শিমুল কিছুই বুঝতে পারছেনা কি বলবে। এমন সময় বৃথার মা ঘরে ঢুকলো। বৃথা মাকে না দেখার ভান করে অন্য রুমে চলে গেলো। শিমুল বৃথার মাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং বলল- – আন্টি আপনাদের এ মহত্বের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবনা। যদি কোন ভুল করে করে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিবেন, তাছাড়া আমিতো আপনার সন্তানের মতোই। যদি পৃথিবীতে বেচে থাকি তাহলে হয়তো আবার দেখা হবে। হঠাৎ বৃথা ঘরের ভিতরে ঢুকেই বলল- -এই রকম সবাই বলে। কিন্তু চলে যাওয়ার পর কেউ আর মনে রাখেনা। মা এবার বৃথার মুখের কথা শুনে শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল- – শুনো তোমার বোন কি বলে এ বলেই বৃথার মা পাশের ঘরে চলে গেলো। বৃথা ও শিমুল কিছুক্ষন নীরব হয়ে দাড়িয়ে রইলো। – সত্যিই কি আপনি চলে যাচ্ছেন? – দেখো বৃথা যেতেতো আআমকে হবেই। তাছাড়া দুর্ঘটনা কবলিত মানুষরা আশ্রয় কেন্দ্রে বেশিক্ষণ থাকতে চাইলেও পারেনা। কেন পারেনা জানো? কারণ স্থানটা অসহায়দের বড় প্রয়োজন। তবে একটা কথা বলতে দ্বিধা নেই সত্যিই তোমরা খুব ভালো। এমন কি তুমিও। তবে তোমাদের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। ভেবোনা পৃথিবীটাতো গোলাকার ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা হয়েও যেতে পারে। তোমাদের এখানে এসে মানবতাবোধের যে পরিচয় পেলাম তা আমার সারা জীবনের জন্য অনুপ্রেরনা হয়ে বেচে থাকবে। কথাগুলো বলতে শিমুল একটা কাগজের মধ্যে নিজের ঠিকানাপত্র লিখে বৃথার হাতে দিল এবং এখানকার ঠিকানা নিজের নোট খাতায় টুকে নিল। এবার শিমুল নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বৃথার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বাহিরে বের হলো। হঠাৎ পিছুন থেকে বৃথার গলার আওয়াজ শুনতে পেল- -শুনুন। শিমুল পেছনে ফিরে তাকালো। বৃথা আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বলল- – আচ্ছা শিমুল ভাই এই মুহূর্তে না গেলে কি হয়না? হঠাৎ শিমুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মিললনা স্বপ্নে দেখা বৃথার প্রশ্নের জবাব। এ মুহূর্তে স্বপ্নের বেড়াজাল থেকে কিছুতেই বেড়তে পারছেনা শিমুল। সে এতক্ষণ যা দেখল তাকি সত্যিই স্বপ্ন নাকি বাস্তব বুঝে ওঠতে পারছেনা। তড়িৎ শোয়া থেকে ওঠে খাটের মধ্যে চাদর জড়ানো অবস্থায় বসে রইল কিছুক্ষণ।

Tag :

জনপ্রিয় সংবাদ

রোজা মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত করে-লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল।

স্বপ্নই ছাই যার —– খোরশেদ আলম বিপ্লব

আপডেট টাইম ০৮:৫১:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ জুন ২০১৯

সবে মাত্র গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো সময় অতিবাহিত হলো, সেই কবে বছর ছয়েক আগে পদার্পণ করেছিল এই রাজশাহী শহরে। চাঁদপুর জেলার অতি নিকটতম থানা মতলবে শিমুলের জন্ম। অন্যান্য চারজনের মতো এইচএসসি টাও সম্পন্ন করল মতলবেই। প্রথমে ইচ্ছে ছিলো ঢাকাতেই পড়াশুনা করার। কিন্তু বাঁধ সাদলো কমপিটিশন আর মজবুত আর্থিক খুঁটি। যার অভাবে প্রাথমিক কমপিটিশনে সফল হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার স্বপ্ন মুছে গেলো। অবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে (অনার্স) পড়ার সুযোগ হলো। তারপর এক এক করে ৬টি বছর কেটে গেলো হোস্টেলের ডালভাত খেয়ে। রাতে একটুও ঘুমাতে পারেনা। বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ এর মধ্যদিয়ে রাত পার করে দিল। সকাল হতে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হল। সারাদিন এই শহরের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বাসায় ফিরতে শিমুলের বিলম্ব হয়ে গেলো। এর মধ্যে ট্রেনের টিকিট কনফার্ম করা হয়েছে, আগামীকাল বিকাল ৫টায় ট্রেন। শিমুল মনে মনে স্থির করলো ঢাকায় এসে প্রথমে মিরপুরে খালার বাসায় উঠবে, সেখানে ২/১ দিন থেকে বাড়ি যাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছ-গাছ করা শেষ। আজ রাতেই রুমমেট জসীম ও আলমগীর এতদিনের বন্ধন ছেড়ে চলে যাবে এজন্য মনটা কিছুটা হলেও খারাপ। কিন্তু যেতে তো হবেই। যে যাবে তাকে তো বেঁধে রাখা যাবে না। সেতো কর্তব্যের টানেই আপনজনের কাছে যেতে চায়। বন্ধুদের ৯টার গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরতে ১০টা বেজে গেলো। শূন্য বিছানায় খানিকটা গা এলিয়ে দিল। খাওয়া দাওয়ার পর্বটা তিনবন্ধু মিলে রেস্টুরেন্টে সেরে এসেছে। হাতমুখ ধুয়ে সোজা খাটের উপরে। সারা দিনের ঘুরাঘুরিতে দু’চোখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। কিছুক্ষণের মধ্যে নিদ্রাদেবীরকোলে ঢলে পড়লো শিমুল। হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে শিমুল স্বপ্ন দেখতে লাগলো। “ব্যগ কাধে করে বিকাল পৌনে ৫টার মধ্যেই হাজির হলো ট্রেন স্টেশনে। টিকিট আগ থেকেই বুকিং করা ছিল, তাই সিট পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। জানালার পাশে শিমুলের সিট। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। দুইবন্ধু বিদায় অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল। ঠিক পাঁচটা বাজতে ট্রেন ছেড়ে দিলো। শিমুল নীরবে বসে এই শহরের স্মৃতি নিয়ে ভাবতে লাগল। এ ভাবনার মাঝে আড়াই ঘণ্টা কেটে গেলো। তাঁর খানিকটা পরে আব্দুল্লাহপুর ষ্টেশন। সেখানে এসে ট্রেন থামল। জানালার পাশে বসে হকার্সদের আত্মচিৎকারে ঘোর কেটে গেলো শিমুলের। সে আগে বহুবার বন্ধুদের কাছে শুনেছে যে কিছু কিছু স্টেশনে যাত্রীদের জিনিসপত্র চুরি হয়। তাই নিজের ব্যগগুলোর প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রেখেছে। শিমুল যে সিটে বসা তা থেকে ৬০-৭০ গজ দুরে স্টেশন অফিস’র দক্ষিণ পাশে একটা গাছ। গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক তাঁর চোখে পড়ল। মাথার চুল এলোমেলো মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে জড়ানো ময়লা চাদর। লোকটার চোখে চখহ পরতেই সে দেখল তাঁর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে। শিমুলের মনে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হলো। ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিলো। শিমুল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো লোকটি এখনও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। খানিক পরেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রেল লাইনের দু’পাশে ঘন গাছ গাছালীতে আবছা অন্ধকার মনে হচ্ছে। ট্রেনটি আরও কিছুক্ষণ চলতে লাগলো। হঠাৎ ট্রেনটি ষ্টেশনবিহীন স্থানে থেমে গেল। কেন থামলো যাত্রীদের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিল। অবশেষে জানা গেল ট্রেনের মেশিন খারাপ হয়েছে তা সারতে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। হঠাৎ শিমুলের মনে হলো তাঁর এক বন্ধু বলেছিল মাঝে মাঝে এভাবে ট্রেন থামিয়ে ডাকাতি হয়। একথা মনে পড়তেই ভয়ের সঞ্চার হলো মনে। হঠাৎ শিমুলের চোখে পড়লো বেশ কিছু লোক ট্রেন থেকে নেমে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা বাজে। ব্যগটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। চারদিকে ঘোর অন্ধকার রাস্তা বুঝার উপায় নেই। পথিমধ্যে সহযাত্রী একজনের কাছে জানতে পারলো খানিকটা সামনে পাকা রাস্তা সেখানে ঢাকাগামী গাড়ি পাওয়া যাবে। একাকি হাটতে লাগলো সামনে, কিছুক্ষণ পর রাস্তার দেখা পেল। কয়েকবার হাত উচিয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। ভাবতে লাগলো এখন কি করা যায়। তাৎক্ষনিক চোখে পড়ল রাস্তা থেকে সোজা পূর্বদিকে একটা বাতির আলো দেখা যায়। মনে মনে ভাবল এখানে কোন লোকালয় হবে। এই ভেবে খানিকটা এগিয়ে গেলো। রাস্তা থেকে একটু নিচে, সমতল ভুমি হতে একটু উচু, সরু রাস্তা দিয়ে সামনের দিকে হাটতে লাগলো। কিছুক্ষণ হাটার পর সামনে একটা বাড়ি দেখতে পেল। সরু রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে হাটতে গিয়ে কয়েক বার হোঁচট খেয়েছে। চারদিক খোলা জায়গা মাঝখানে বাড়িটি নীরব নিস্তব্দ মুনে হয়। বাড়িটির এক কোণে একটা বাতি, যার আলোতে ছোট উঠোনটি পেরিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই। দুটি ঘরের মধ্যে কেউনা কেউতো নিশ্চয়ই থাকে। এই ভেবে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। এই মুহূর্তে নিজেকে কেন যেন অসহায় চোরের মতো মনে হচ্ছে। হঠাৎ শিমুলের কানে গুণ গুণ আওয়াজ ভেসে এলো। খানিকটা এগিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে শিমুল বুঝতে পারল ঘরের ভিতরে কেউ বই পড়ছে। পড়ার মৃদু শব্দ কানের দ্বার পর্যন্ত পৌছামাত্র মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকে কিছুটা সাহস নিয়ে গলা কাঁশির শব্দ করে উঠল। কোন সাড়া শব্দ নেই। দ্বিতীয়বার শব্দ করতেই ভিতর পড়ার শব্দ থেমে গেলো। শিমুল বাহির থেকে জিজ্ঞাসা করল- -কেউ কি বাড়িতে আছেন? ভিতর থেকে কোন সাড়া শব্দ এলোনা। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করল, “প্লিজ ঘরের ভিতর কেউ কি আছেন? এবার স্পষ্ট ভাষায় একটা মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে আসলো- -বাড়িতে কেউ নেই। হঠাৎ পাশের রুম থেকে কে যেন বলে উঠল- বাহিরে কে কথা বলছেরে মা? -শিমুল বলল- “প্লিজ দরজাটা একটু খুলবেন?” কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলে ভিতর থেকে অর্ধ বয়সী একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করল- -আপনি কোথা থেকে এসেছেন এবং কাকে চান? -দেখুন আমি রাজশাহী থেকে ট্রেনে এসেছি, এবং যাব ঢাকা। পথিমধ্যে ট্রেনের মেশিন খারাপ হওয়াতে বিলম্ব হচ্ছিল তাঁর উপর কিচ্ছুক্ষণ আগে ট্রেনে ডাকাতি হয়েছে। আমি ব্যপারটা আগে বুঝতে পেরে ডাকাত দল ট্রেনে পৌছার আগেই চলে এসেছি রাস্তায় কিছুদুর আসার পর ডাকাত ডাকাত চিৎকার শুনতে পেওে বুঝতে পারলাম অঘটন ঘটেছে। এমতাবস্থায় এতরাতে কোথায় যাব বুঝতে পারছিনা, তাই অন্তত আজকের রাতটা যদি আপনাদের এখানে থাকতে দিতেন। শিমুলের কথা শুনে এবার মহিলাটি বলল- -দেখুন আমাদের বাড়িতে কোন পুরুষ লোক নেই। এমতাবস্থায় আপনাকে…। কথাগুলো শেষ না হতেই শিমুল মনটা খারাপ করে হাটতে শুরু করল। ঘরের ভেতর থেকে একটি মেয়ে তার মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। হঠাৎ মহিলাটি পিছন থেকে ডাকলো- -শুনুন! – এত রাতে আপনি কোথায় যাবেন সেকথা কি ভেবেছেন? -না ভাবিনী। -ঠিক আছে আপনি ভিতরে আসুন। শিমুল এ মুহূর্তে যেন আনন্দের সাগরে ভেসে গেলো। সমস্ত ভয় আর ক্লান্তি কেটে আনন্দের ছোঁয়া লাগল মনে ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে ঢুকল। মেয়েটির চেহারা দেখে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে মায়ের সিদ্ধান্তে সে কিছুটা বিরক্ত এতরাতে অপরিচিত লোক…। -আসলে আপনাদের যে কি দিয়ে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছিনা। ভাববেন না, আমি সকাল হতেই চলে যাবো। নিজের ব্যগটা টেবিলের উপর রেখে পাশের খাটে গিয়ে বসল। মহিলাটি এবার শিমুলের পাশে বসে সমস্ত ঘটনা জানতে পারল। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন এ চলে এসেছে। -ঠিক আছে বাবা তুই হাত মুখ ধুয়ে এসো, আগে চারটা খাবে তাঁর পর তোমার সবকথা শুনতে পারব, আর হে এ আমার মেয়ে বৃথা। এবার আইএ পড়ছে। ওর বাবা তহসিল অফিসে চাকুরি করে অফিসের কাজে আজই বাহিরে গেছে। আর আমার একমাত্র ছেলে জয় একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকুরি করছে। বৃথার মা শিমুলের সাথে কথা বলে ভিতরের রুমে খাবার আনতে চলে গেলো। এদিকে বৃথা শিমুলকে নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে নিয়ে গেলো। শিমুল হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল। বৃথা এটা সেটা দিতে শিমুলের সামনে আসে। মেয়েটি কিছুটা লাজুক স্বভাবের দেখেই মনে হচ্ছে। শিমুলের খেতে খেতে বৃথার সাথে অনেক কথা হলো। অনেক কথার মাঝে হঠাৎ শিমুল বলল- -আমি তোমাদের খুব বিপদে ফেলে দিলাম তাইনা বৃথা? সত্যিই তোমাদের মতো মানুষ হয়না, তোমাদের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করলেও ঋণ শোধ হবেনা। -না না- তা কেন, আপনি এটাকে এভাবে দেখছেন কেন? বিপদ হয়েছে বলেই এখানে এসেছেন। যদি আপনি আজ এভাবে বিপদে না পড়তেন তাহলে এখানে আপনি আসতেনও না আর আমাদের সাথে পরিচয়ই হতনা। তাছাড়া বিপদতো কখন বলে আসেনা। কথা শেষ না হতেই বৃথা মায়ের নির্দেশে পাশের ঘরটিতে গেলো। ঐ ঘরটিতে বৃথার বড় ভাই থাকতো। আজ রাতে শিমুলকে ওখানেই থাকতে হবে। তাইতো বৃথা নিজ হাতে বিছানাপত্র গোছাতে লাগলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শিমুলের সাথে বৃথা ও তাঁর মায়ের অনেক কথা হলো। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইল বৃথাও। এবার পাশের রুম খুলে দিয়ে সেখানে শিমুল যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলো। শিমুল পাশের ঘরটিতে ঢুকে নিজের ব্যগ থেকে লুঙ্গি বের করে পরছিল এমন সময় বৃথা ভিতরে ঢুকল- শিমুল তড়িঘড়ি করে লুঙ্গিটা পড়ে নিল। বৃথা পানির জগ আর সাথে গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলল- -রাতে কোন সমস্যা হলে মাকে ডাকবেন। আমরা গরীব মানুষ। এই রাতটা না হয় আপনার একটু সমস্যা হবে। কিছু মনে না করলেই খুশি হবো” -দেখো বৃথা তোমরা আমার জন্য যা করলে তা হয়তো কেউ করবেনা। হঠাৎ মায়ের ডাক শুনে বৃথা শিমুলের শেষ কথাটুকু না শুনে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেলো। শিমুল দরজায় খিল দিয়ে খাটের উপর গাঁ এলিয়ে দিল। মা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। এদিকে বৃথা শিমুলকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠালো। সারারাত কীভাবে কেটে গেছে শিমুল টের পায়নি। হঠাৎ বৃথা শিমুলকে জিজ্ঞাসা করল- -রাতে ঘুম হয়নি বুঝি? -না-খুব ভালো ঘুম হয়েছে। আমি বুঝতেই পারিনি কখন ভোর হলো। বলেই শিমুল হেসে ওঠল, বিছানা থেকে ওঠে সোজা গোসল সেরে যাওয়ার জন্য তৈরি এমন সময় বৃথার মা ঘরে ঢুকল। -কি ব্যপার শিমুল এত তাড়াহুড়া করছ কেন? এখান থেকে দিনের বেলায় যেকোনো সময় গাড়ি পাওয়া যাবে। তাছাড়া আগে খাওয়া-দাওয়া করো তারপর না হয় চলেই যাবে। কথাগুলো বলেই বৃথার মা পাশের রুমে চলে গেল। এদিকে বৃথা নাস্তার প্লেট নিয়ে শিমুলের সামনে হাজির। শিমুল নাস্তা খাওয়ার ফাকে ফাকে বৃথার দিকে তাকাচ্ছে। বৃথা যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছেনা। এই মুহূর্তে শিমুল হঠাৎ বলল- – বৃথা তোমরা আমার জন্য যা করলে তা পৃথিবীতে আর কেউ করবে কি না আমি জানিনা। তবে তোমাদের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কথা বলতে বলতে শিমুল ভাল করে বৃথার মুখপানে তাকালো। চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো চোখগুলো কিঞ্চিৎ ফোলা সারারাত হয়ত মেয়েটি ঘুমায়নি। – কি ব্যপার বৃথা। সত্যি করে বলতো তুই কি সারারাত ঘুমাওনি? মাথা নিচু করে এবার বৃথা নিম্নস্বরে বলল- -আসলে সারারাত বারবার কেমন যেন আপনার কথা মনে হয়েছে। সত্যি মানুষের জীবন কত বিচিত্র তাইনা। কতভাবে কত মানুষের সাথে দেখা পরিচয় হয় আবার চলেও যায়। – সত্যিই আমি তোমাদের কাছে অপরাধী হয়ে গেল্ধাসঢ়;ম‌, যে তুমি আমার জন্য ঘুমাতে পর্যন্ত পারনি। সত্যিই আমি দুঃখিত। কিন্তু তোমাদের বাড়ি থাকা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। – আমি কিন্তু আপনার থাকা নিয়ে কিছু বলছিনা – তাহলে? (বিস্মিত হয়ে) – কেন যেন আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে আপনি আমাদের কত চেনা আত্মীয়। যখনই মায়ের মুখে শুনলাম এক্ষুণি চলে যাবেন, খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কেন যেন বুঝতে পারছি না। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। শিমুল এতক্ষণ মাথানিচু করে বৃথার কথাগুলো শুনছিল। মাথা উচু করে বৃথার দিকে তাকাল। বৃথার দু’চোখে জল দেখে শিমুল কিছুই বুঝতে পারছেনা কি বলবে। এমন সময় বৃথার মা ঘরে ঢুকলো। বৃথা মাকে না দেখার ভান করে অন্য রুমে চলে গেলো। শিমুল বৃথার মাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং বলল- – আন্টি আপনাদের এ মহত্বের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবনা। যদি কোন ভুল করে করে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিবেন, তাছাড়া আমিতো আপনার সন্তানের মতোই। যদি পৃথিবীতে বেচে থাকি তাহলে হয়তো আবার দেখা হবে। হঠাৎ বৃথা ঘরের ভিতরে ঢুকেই বলল- -এই রকম সবাই বলে। কিন্তু চলে যাওয়ার পর কেউ আর মনে রাখেনা। মা এবার বৃথার মুখের কথা শুনে শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল- – শুনো তোমার বোন কি বলে এ বলেই বৃথার মা পাশের ঘরে চলে গেলো। বৃথা ও শিমুল কিছুক্ষন নীরব হয়ে দাড়িয়ে রইলো। – সত্যিই কি আপনি চলে যাচ্ছেন? – দেখো বৃথা যেতেতো আআমকে হবেই। তাছাড়া দুর্ঘটনা কবলিত মানুষরা আশ্রয় কেন্দ্রে বেশিক্ষণ থাকতে চাইলেও পারেনা। কেন পারেনা জানো? কারণ স্থানটা অসহায়দের বড় প্রয়োজন। তবে একটা কথা বলতে দ্বিধা নেই সত্যিই তোমরা খুব ভালো। এমন কি তুমিও। তবে তোমাদের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। ভেবোনা পৃথিবীটাতো গোলাকার ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা হয়েও যেতে পারে। তোমাদের এখানে এসে মানবতাবোধের যে পরিচয় পেলাম তা আমার সারা জীবনের জন্য অনুপ্রেরনা হয়ে বেচে থাকবে। কথাগুলো বলতে শিমুল একটা কাগজের মধ্যে নিজের ঠিকানাপত্র লিখে বৃথার হাতে দিল এবং এখানকার ঠিকানা নিজের নোট খাতায় টুকে নিল। এবার শিমুল নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বৃথার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বাহিরে বের হলো। হঠাৎ পিছুন থেকে বৃথার গলার আওয়াজ শুনতে পেল- -শুনুন। শিমুল পেছনে ফিরে তাকালো। বৃথা আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বলল- – আচ্ছা শিমুল ভাই এই মুহূর্তে না গেলে কি হয়না? হঠাৎ শিমুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মিললনা স্বপ্নে দেখা বৃথার প্রশ্নের জবাব। এ মুহূর্তে স্বপ্নের বেড়াজাল থেকে কিছুতেই বেড়তে পারছেনা শিমুল। সে এতক্ষণ যা দেখল তাকি সত্যিই স্বপ্ন নাকি বাস্তব বুঝে ওঠতে পারছেনা। তড়িৎ শোয়া থেকে ওঠে খাটের মধ্যে চাদর জড়ানো অবস্থায় বসে রইল কিছুক্ষণ।