ঢাকা ০৮:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বগুড়ায় চাঞ্চ্যল্যকর শিশু বন্ধনকে গলাকেটে হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন গজারিয়ায় দুই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিরুল ইসলাম এর পক্ষে গনসংযোগ ও লিফলেট বিতরন প্রাণীসম্পদ প্রদর্শনী সেবা সপ্তাহ উপলক্ষে আলোচনা ও পুরুষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান –অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা হতে ০৪ জন পরিবহন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০। চট্টগ্রামে দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে-২ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা বিএমএর হকার আর যত্রতত্র আবর্জনা কমাতে অভিযানের ঘোষণা মেয়র রেজাউলের রামগঞ্জে প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী ২০২৪ অনুষ্ঠিত। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন পরিবর্তনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন গজারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে দিনভর গনসংযোগ ও লিফলেট বিতরন গজারিয়ায় নারী উদ্যোক্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

সুখের খোঁজে কবির কাঞ্চন

মাতৃভূমির খবর ডেক্স :

গভীর রাত। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার।
বিশালাকার ফ্ল্যাটে একাকী নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন মোবাশ্বের হোসেন। চাইলে সব অন্ধকার নিমিষেই তাড়িয়ে দিতে পারেন। তবু দ্বিধাগ্রস্ত মনে ফ্ল্যাটের বাতি জ্বালাতে চাইছেন না।

আজ কেন জানি শত চেষ্টা সত্ত্বেও তার চোখের পাতা জোড়া যুক্ত হচ্ছে না। জীবনের এতোপথ অতিক্রম করে এসে আজ তিনি নিঃসঙ্গ। একান্ত আপনজনেরা তাকে ছেড়ে দূরে-বহুদূরে চলে গেছে। কেউ ইচ্ছায়। কেউবা স্রষ্টার আহবানে।
যেদিন শেষবারের মতো প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাড়ির দক্ষিণে রেখে এসেছিলেন সেইদিন থেকে তিনি একাকীত্বের বিভীষিকাময় মুহূর্তকে জীবনে আলিঙ্গন করেছেন।

একমাত্র ছেলের সব আবদার রক্ষা করতে ন্যায়-অন্যায়ের পথে দু’হাতে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন। আজ তার চারিদিকে শুধুই শূন্যতা। বাসার সেই পুরনো চাকর রমজান আলীই তাকে ছেড়ে যায়নি।
মালিকের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সেই রমজান আলীই এখন তার নিত্যসঙ্গী। পরম আপনজন। জীবনের একান্ত দুঃসময়ের সঙ্গী।
শরীরটাও এখন আর আগের মতো তার ইচ্ছামতো কাজ করে না। এই ভালো তো এই খারাপ। প্রায়ই বিছানাকে আপন করে নিতে হয়। এসময় ঘুরেফিরে ওই একটি বিশ্বস্ত হাতই খুঁজে পান তিনি।

রমজান আলীর কিশোরকাল, যৌবনকাল কেটেছে মোবাশ্বের হোসেনের বাসাকে ঘিরেই। নিজের পরিবারের সদস্যদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবতে ভাবতে কখনও রমজান আলীকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবা হয়নি। মাস শেষে হাতে কিছু বেতন দিয়েই তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন।
” রমজান তার জীবনের অধিকাংশ সময় আমাদের কল্যাণে কাটিয়েছে। সে তুলনায় আমি কী আমার সব দায়িত্ব পালন করেছি? এই সামান্য টাকা দিয়ে তার সংসার ঠিকমতো চলে কিনা তার কোন খবর কী নিয়েছি? তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কিংবা বাবা-মাকে নিয়ে আসলে ও কেমন আছে?” আজ বারবার মোবাশ্বের হোসেনের মনে এমন অসংখ্য প্রশ্ন জাগছে।

রাত সাড়ে বারোটা বাজে। রমজান আলী বাইরে থেকে দরজার কলিংবেলে আঙুল চাপলো। মোবাশ্বের হোসেন দরজা খুলে রমজানের মুখের দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
– তুমি এখনও যাওনি!
– না, আপনাকে এভাবে রেখে আমি কেমন করে যেতে পারি?
– তোমার বৌ, ছেলেমেয়ে তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
– জ্বি, তা করছে। কিন্তু যে মানুষটির জন্য আমরা সবাই বেঁচে আছি তাকে অসুস্থ রেখে যাওয়া তো অমানুষের কাজ।
– তোমার বৌ, ছেলেমেয়েরা তোমার সাথে রাগ করতে পারে।
– না, রাগ করবে না। ওরা আমাকে বিশ্বাস করে। খুব ভালোবাসে। আমি না গেলে ভাববে আমি হয়তো কোন জরুরী কাজে আটকে গেছি।
– ওহ্! আচ্ছা। তোমার ছেলেটার পড়াশোনার কী খবর?
রমজান আলী খুশি মনে বলল,
– ও এবছর ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিবে।
– ওর যাবতীয় খরচাপাতি কিভাবে ব্যবস্থা করো?
– বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় খরচাপাতি কম লাগে না। শুধু আসা-যাওয়ায় কিছু খরচ লাগে। ছেলে আমার খুব ভালো। বাবার অবস্থার কথা চিন্তা করে দু’টো টিউশনি করে। তাতেই তার হয়ে যায়। তারউপর প্রতিমাসে আমার হাতে কিছু টাকা তুলে দেয়। সত্যি কথা বলতে কী- আমি তা নিতে চাই না। আমি মনে করি, ওর এখন শেখার সময়। শুধু আমাদের সংসারের কথা ভেবে ও তার সেসময় থেকে কিছু সময় টিউশনিতে ব্যয় করছে। এতে আমরা সাময়িক লাভবান হলেও বাস্তবে ওর ক্ষতি হচ্ছে।
– সামনে তো ওর ফাইনাল পরীক্ষা। আপাতত টিউশনি বাদ দিতে বলো। আর হ্যাঁ, আমি ওর জন্য তোমাকে কিছু টাকা দেবো। আমি চাই তোমার স্বপ্ন সফল হোক।
– না, স্যার, আমাদের অতিরিক্ত কোন টাকা লাগবে না। আপনি শুধু আমার ছেলের জন্য দোয়া করুন।

মোবাশ্বের হোসেন আলমারির ভেতর থেকে দশ হাজার টাকা এনে রমজান আলীর হাতে দিয়ে বললেন,
– আর না করো না। এগুলো তোমার কাছে রেখে দাও। ছেলের জন্য হঠাৎ দরকার হলে খরচ করবে।
দ্যাখো রমজান, তুমি তো দেখেছো আমি আমার ছেলের জন্য কতো টাকা উড়িয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকলো না। কলেজে ও পড়বে না। শেষে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালাম। তারপর আমাদেরকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করলো। আবার শ্বশুরের প্ররোচনায় বিদেশে চলে গেলো। কখনও নিজ থেকে কল দেয় না। আমার মন খারাপ হলে যখন কল দিই তখন কল রিসিভ করলেও ওর সাথে মন ভরে কথা বলতে পারিনা। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু তোমার মতো একটি সন্তান দেননি।
– স্যার, মন খারাপ করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মন বলছে, একদিন ছোট সাহেব নিশ্চয় তার ভুল বুঝতে পারবেন।
– সেইদিনের জন্যই তো আজও বেঁচে আছি, রমজান।

রমজান আলী দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
– স্যার, রাত একটা পনেরো মিনিট। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি তাহলে বাসার দিকে ফিরে যাই। সকালে ভোরে ভোরে আসবো।
– আগামিকাল আবার কষ্ট করে বাসায় আসার দরকার নেই। ফজরের নামায আমরা একসাথে মসজিদে পড়বো। তারপর বাসায় আসবো।
– আচ্ছা।
এই বলে রমজান আলী নিজের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

ফজরের আযান শুনে মোবাশ্বের হোসেনের ঘুম ভাঙে। এরপর ওযু করে আস্তে আস্তে মসজিদের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ততক্ষণে রমজান আলী মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
দু’জনে জমায়েতে নামায আদায় করলেন। এরপর মর্নিং ওয়াকে বের হলেন। কিছুদূর অতিক্রম করার পর রাস্তার পাশের ফুটপাতে একজন লোককে পাতলা কাপড় গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন।

লোকটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মোবাশ্বের হোসেন কয়েকবার লোকটাকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু মধুর ঘুমে মগ্ন মানুষকে জাগানো এতো সহজ না। শেষে রমজান আলী এগিয়ে এসে লোকটার শরীরকে নাড়া দিলে তার ঘুম ভাঙে। সে ঘুমঘুম চোখে বলল,
– কে আপনারা? আমার এত মধুর একটা ঘুমকে নষ্ট করে দিলেন।
মোবাশ্বের হোসেন বললেন,
– এখানে এভাবে ঘুমাচ্ছেন কেন? আপনার বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারেন না?
– বাসা থাকলেই তো বাসায় গিয়ে ঘুমাতাম।
– বাসা নেই মানে!
– একসময় বাসা ছিল। টাকা-পয়সা ছিল। বৌ-বাচ্চা ছিল। সবার জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। কখনও আলাদা করে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি। তাদের সকল চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতেই আমি নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। কিন্তু ব্যবসায় লোকসানে পড়ে
নিঃস্ব হয়ে গেলে আমার কাছের মানুষেরাও আমায় ছেড়ে দূরে সরে যায়। তবুও আমি তাদের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিল না। শেষমেশ রাস্তায় নামতে হলো। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন তা সয়ে গেছে। এখন আর মনে কোন কষ্ট লাগে না। এখন ভাবি- জীবন তো একটাই। যেনতেন করে চলে যাবে। এখন তো পাঁচ ওয়াক্ত নামায জমায়েতের সাথে পড়তে পারি। আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণভরে কাঁদতে পারি। আগে তো আমার অনেক অনেক ব্যস্ততা ছিল। আগে ঘুমাতে চাইলেও ঘুম আসতো না। আর এখন এই ফুটপাতে গা রাখতেই তৃপ্তির ঘুম নেমে আসে। বলুন, জগতে আমার চেয়ে সুখি আর কে আছে? মোবাশ্বের হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন।

মোবাশ্বের হোসেন রমজান আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার লোকটার দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে-
কী বিচিত্র এই পৃথিবী! কারো আছে অঢেল সম্পত্তি। রঙবেরঙের অত্যাধুনিক সুবিধাময় ভবন। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই।
আর কারো শোবার ঘর নেই। অথচ তাদের চোখে শান্তির ঘুম। তাদের মনে জগতের সুখ।

লেখক : কবির কাঞ্চন

 

Tag :

জনপ্রিয় সংবাদ

বগুড়ায় চাঞ্চ্যল্যকর শিশু বন্ধনকে গলাকেটে হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন

সুখের খোঁজে কবির কাঞ্চন

আপডেট টাইম ০৭:১৫:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

মাতৃভূমির খবর ডেক্স :

গভীর রাত। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার।
বিশালাকার ফ্ল্যাটে একাকী নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন মোবাশ্বের হোসেন। চাইলে সব অন্ধকার নিমিষেই তাড়িয়ে দিতে পারেন। তবু দ্বিধাগ্রস্ত মনে ফ্ল্যাটের বাতি জ্বালাতে চাইছেন না।

আজ কেন জানি শত চেষ্টা সত্ত্বেও তার চোখের পাতা জোড়া যুক্ত হচ্ছে না। জীবনের এতোপথ অতিক্রম করে এসে আজ তিনি নিঃসঙ্গ। একান্ত আপনজনেরা তাকে ছেড়ে দূরে-বহুদূরে চলে গেছে। কেউ ইচ্ছায়। কেউবা স্রষ্টার আহবানে।
যেদিন শেষবারের মতো প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাড়ির দক্ষিণে রেখে এসেছিলেন সেইদিন থেকে তিনি একাকীত্বের বিভীষিকাময় মুহূর্তকে জীবনে আলিঙ্গন করেছেন।

একমাত্র ছেলের সব আবদার রক্ষা করতে ন্যায়-অন্যায়ের পথে দু’হাতে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন। আজ তার চারিদিকে শুধুই শূন্যতা। বাসার সেই পুরনো চাকর রমজান আলীই তাকে ছেড়ে যায়নি।
মালিকের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সেই রমজান আলীই এখন তার নিত্যসঙ্গী। পরম আপনজন। জীবনের একান্ত দুঃসময়ের সঙ্গী।
শরীরটাও এখন আর আগের মতো তার ইচ্ছামতো কাজ করে না। এই ভালো তো এই খারাপ। প্রায়ই বিছানাকে আপন করে নিতে হয়। এসময় ঘুরেফিরে ওই একটি বিশ্বস্ত হাতই খুঁজে পান তিনি।

রমজান আলীর কিশোরকাল, যৌবনকাল কেটেছে মোবাশ্বের হোসেনের বাসাকে ঘিরেই। নিজের পরিবারের সদস্যদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবতে ভাবতে কখনও রমজান আলীকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবা হয়নি। মাস শেষে হাতে কিছু বেতন দিয়েই তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন।
” রমজান তার জীবনের অধিকাংশ সময় আমাদের কল্যাণে কাটিয়েছে। সে তুলনায় আমি কী আমার সব দায়িত্ব পালন করেছি? এই সামান্য টাকা দিয়ে তার সংসার ঠিকমতো চলে কিনা তার কোন খবর কী নিয়েছি? তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কিংবা বাবা-মাকে নিয়ে আসলে ও কেমন আছে?” আজ বারবার মোবাশ্বের হোসেনের মনে এমন অসংখ্য প্রশ্ন জাগছে।

রাত সাড়ে বারোটা বাজে। রমজান আলী বাইরে থেকে দরজার কলিংবেলে আঙুল চাপলো। মোবাশ্বের হোসেন দরজা খুলে রমজানের মুখের দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
– তুমি এখনও যাওনি!
– না, আপনাকে এভাবে রেখে আমি কেমন করে যেতে পারি?
– তোমার বৌ, ছেলেমেয়ে তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
– জ্বি, তা করছে। কিন্তু যে মানুষটির জন্য আমরা সবাই বেঁচে আছি তাকে অসুস্থ রেখে যাওয়া তো অমানুষের কাজ।
– তোমার বৌ, ছেলেমেয়েরা তোমার সাথে রাগ করতে পারে।
– না, রাগ করবে না। ওরা আমাকে বিশ্বাস করে। খুব ভালোবাসে। আমি না গেলে ভাববে আমি হয়তো কোন জরুরী কাজে আটকে গেছি।
– ওহ্! আচ্ছা। তোমার ছেলেটার পড়াশোনার কী খবর?
রমজান আলী খুশি মনে বলল,
– ও এবছর ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিবে।
– ওর যাবতীয় খরচাপাতি কিভাবে ব্যবস্থা করো?
– বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় খরচাপাতি কম লাগে না। শুধু আসা-যাওয়ায় কিছু খরচ লাগে। ছেলে আমার খুব ভালো। বাবার অবস্থার কথা চিন্তা করে দু’টো টিউশনি করে। তাতেই তার হয়ে যায়। তারউপর প্রতিমাসে আমার হাতে কিছু টাকা তুলে দেয়। সত্যি কথা বলতে কী- আমি তা নিতে চাই না। আমি মনে করি, ওর এখন শেখার সময়। শুধু আমাদের সংসারের কথা ভেবে ও তার সেসময় থেকে কিছু সময় টিউশনিতে ব্যয় করছে। এতে আমরা সাময়িক লাভবান হলেও বাস্তবে ওর ক্ষতি হচ্ছে।
– সামনে তো ওর ফাইনাল পরীক্ষা। আপাতত টিউশনি বাদ দিতে বলো। আর হ্যাঁ, আমি ওর জন্য তোমাকে কিছু টাকা দেবো। আমি চাই তোমার স্বপ্ন সফল হোক।
– না, স্যার, আমাদের অতিরিক্ত কোন টাকা লাগবে না। আপনি শুধু আমার ছেলের জন্য দোয়া করুন।

মোবাশ্বের হোসেন আলমারির ভেতর থেকে দশ হাজার টাকা এনে রমজান আলীর হাতে দিয়ে বললেন,
– আর না করো না। এগুলো তোমার কাছে রেখে দাও। ছেলের জন্য হঠাৎ দরকার হলে খরচ করবে।
দ্যাখো রমজান, তুমি তো দেখেছো আমি আমার ছেলের জন্য কতো টাকা উড়িয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকলো না। কলেজে ও পড়বে না। শেষে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালাম। তারপর আমাদেরকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করলো। আবার শ্বশুরের প্ররোচনায় বিদেশে চলে গেলো। কখনও নিজ থেকে কল দেয় না। আমার মন খারাপ হলে যখন কল দিই তখন কল রিসিভ করলেও ওর সাথে মন ভরে কথা বলতে পারিনা। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু তোমার মতো একটি সন্তান দেননি।
– স্যার, মন খারাপ করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মন বলছে, একদিন ছোট সাহেব নিশ্চয় তার ভুল বুঝতে পারবেন।
– সেইদিনের জন্যই তো আজও বেঁচে আছি, রমজান।

রমজান আলী দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
– স্যার, রাত একটা পনেরো মিনিট। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি তাহলে বাসার দিকে ফিরে যাই। সকালে ভোরে ভোরে আসবো।
– আগামিকাল আবার কষ্ট করে বাসায় আসার দরকার নেই। ফজরের নামায আমরা একসাথে মসজিদে পড়বো। তারপর বাসায় আসবো।
– আচ্ছা।
এই বলে রমজান আলী নিজের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

ফজরের আযান শুনে মোবাশ্বের হোসেনের ঘুম ভাঙে। এরপর ওযু করে আস্তে আস্তে মসজিদের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ততক্ষণে রমজান আলী মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
দু’জনে জমায়েতে নামায আদায় করলেন। এরপর মর্নিং ওয়াকে বের হলেন। কিছুদূর অতিক্রম করার পর রাস্তার পাশের ফুটপাতে একজন লোককে পাতলা কাপড় গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন।

লোকটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মোবাশ্বের হোসেন কয়েকবার লোকটাকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু মধুর ঘুমে মগ্ন মানুষকে জাগানো এতো সহজ না। শেষে রমজান আলী এগিয়ে এসে লোকটার শরীরকে নাড়া দিলে তার ঘুম ভাঙে। সে ঘুমঘুম চোখে বলল,
– কে আপনারা? আমার এত মধুর একটা ঘুমকে নষ্ট করে দিলেন।
মোবাশ্বের হোসেন বললেন,
– এখানে এভাবে ঘুমাচ্ছেন কেন? আপনার বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারেন না?
– বাসা থাকলেই তো বাসায় গিয়ে ঘুমাতাম।
– বাসা নেই মানে!
– একসময় বাসা ছিল। টাকা-পয়সা ছিল। বৌ-বাচ্চা ছিল। সবার জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। কখনও আলাদা করে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি। তাদের সকল চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতেই আমি নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। কিন্তু ব্যবসায় লোকসানে পড়ে
নিঃস্ব হয়ে গেলে আমার কাছের মানুষেরাও আমায় ছেড়ে দূরে সরে যায়। তবুও আমি তাদের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিল না। শেষমেশ রাস্তায় নামতে হলো। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন তা সয়ে গেছে। এখন আর মনে কোন কষ্ট লাগে না। এখন ভাবি- জীবন তো একটাই। যেনতেন করে চলে যাবে। এখন তো পাঁচ ওয়াক্ত নামায জমায়েতের সাথে পড়তে পারি। আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণভরে কাঁদতে পারি। আগে তো আমার অনেক অনেক ব্যস্ততা ছিল। আগে ঘুমাতে চাইলেও ঘুম আসতো না। আর এখন এই ফুটপাতে গা রাখতেই তৃপ্তির ঘুম নেমে আসে। বলুন, জগতে আমার চেয়ে সুখি আর কে আছে? মোবাশ্বের হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন।

মোবাশ্বের হোসেন রমজান আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার লোকটার দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে-
কী বিচিত্র এই পৃথিবী! কারো আছে অঢেল সম্পত্তি। রঙবেরঙের অত্যাধুনিক সুবিধাময় ভবন। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই।
আর কারো শোবার ঘর নেই। অথচ তাদের চোখে শান্তির ঘুম। তাদের মনে জগতের সুখ।

লেখক : কবির কাঞ্চন