ঢাকা ০৪:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
“মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন” ইন্দুরকানীতে দিনব্যাপী পারিবারিক পুষ্টি বাগান ও বস্তায় আদা চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে চুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন … লালমনিরহাটে বৃষ্টির জন‍্য বিশেষ নামাজ আদায় মিছিল ও শোডাউন করায় মতলব উত্তর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মানিক দর্জিকে শোকজ –গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা এলাকায় স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা মামলার পলাতক প্রধান আসামি শ্রী রুপেন দাশ’কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব । চন্দনাইশে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু ইষ্টার্ণ হাউজিংয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় সাংবাদিকদের উপর হামলা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কোরআন শরিফ অবমাননা করায় মানববন্ধন রাঙ্গুনিয়ায় সড়ক দূর্ঘটনার চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু

শূন্যতা

শাহানাজ পারভীন শিউলী

খক খক করে কাশছে হাবিব সাহেব।বেশ কিছুদিন তার শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছেনা। গায়ে প্রচন্ড জ্বর।বমি বমি ভাব। তাই সে তিনদিন ছুটি নিলো।হাবিব সাহেব সুগার মিলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।তিন ছেলে-মেয়ে । বড় ছেলে জিহান বাংলায় অনার্স ১ম বর্ষ। মেজো ছেলে জিসান দশম শ্রেণিতে,ছোট মেয়ে জয়া সপ্তম শ্রেণিতে। স্ত্রী রোকেয়া পাঁচ বছর গত হয়েছেন রোড এক্সিডেন্ট এ। তারপর থেকে হাবিব সাহেব আর বিয়ে করেননি। তিন সন্তানকে বুকে আগলে রেখে সংসার করে যাচ্ছিলেন। যদিও স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

কলেজ থেকে জিহান বাসায় ফিরলো। বাবাকে দেখেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,কি হয়েছে বাবা? আজ তুমি অফিসে যাওনি?বাবা,বললেন,না।শরীরটা বেশ কিছুদিন ভাল যাচ্ছেনা। কই,আমাকে তো কিছুই বলোনি? বাবা বললেন,সামান্য জ্বর,ঠিক হয়ে যাবে তাই বলিনি। গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠলো জিহান। একি! গায়ে তো প্রচন্ড জ্বর! জিহান সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো।।ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে বললেন, এই ঔষধগুলো ঠিকমত খাওয়াবেন। সাতদিন পর নিয়ে আসবেন।

দিনে দিনে হাবিব সাহেবের শরীরের অবস্থা আরোও খারাপ হতে লাগলো। জিহানের দুঃচিন্তার কোনো শেষ নেই। মা বেঁচে নেই আজ পাঁচ বছর। বাবা কখনও আমাদের মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। আজ যদি বাবার কিছু হয়ে যায়——–।
কত কথা মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে জিহানের। নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছে। কেন বাবাকে এতদিন বোঝার চেষ্টা করিনি? কেন এক দিনও বুকে জড়িয়ে ধরে বলিনি, বাবা তুমি কেমন আছো? তার শূন্যতাকে কেন উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি? বটবৃক্ষের মতো তিনি নিজেকে উজাড় করে আমাদের মাথার উপর শীতল ছায়া দিয়ে গেছেন। নিজের বুকের উপর পাথর চেপে সুখী রেখেছেন, নীল বেদনাগুলো ঢেকে রেখে অধরের কোণে হাসি দিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেছেন, এগিয়ে চলো, এই তো আমি আছি তোমাদের সাথে। হাত দু,টি তার বড়ই সহানুভূতির, মমত্ববোধের,নির্ভরশীলতার। বার বার জিহান নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমি তো পারতাম বাবার কাঁধে হাতটা রাখতে। একটু সুখের কাজল মেখে দিতে।কখনও তো খেয়াল করিনি বাবার পায়ের স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেছে কিনা। শার্টের নীচের গেঞ্জিটা ছেড়া কিনা। বাবা সবাইকে যখন ঈদের পোশাক কিনে দিতো,তখন কখনও এসে বলিনি,বাবা তোমার পাঞ্জাবিটা কই? তোমার পছন্দের খাবারগুলো কি? কখনও তো জানতেও চায়নি। তার নির্ভরশীলতার জায়গাটা কখনও খোঁজার চেষ্টা করিনি। আর বাবা সব সময় আমাদের আবদার, চাহিদা পূরণ করে গেছেন। তিনি পরিবারের এতগুলো মানুষকে ভাল রেখেছেন আর আমরা সবাই মিলে একজন বাবাকে ভালো রাখতে পারেনি। বাবার শিয়রে বসে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছে আর ঈশ্বরকে ডাকছে। হে আমার ঈশ্বর, আর একবার সুযোগ দাও। বাবাকে সেবা করার, ভাল রাখার। আমি কথা দিচ্ছি, বাবা সেরে উঠলেই আমি তার দায়িত্ব নেবো। তাকে আর কষ্ট পেতে দেবো না। এসব বলছে আর বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ।

সকাল দশটাই ডাক্তার সাহেব জিহানের কাছে ফোন দিলো রিপোর্টগুলো নেওয়ার জন্য। জিহান রিপোর্ট আনতে গেলো। ডাক্তারের মুখ দেখেই জিহানের বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। জিহান ডাক্তারকে ধরে বলল, ডাক্তার সাহেব, বাবা ঠিক আছে তো? ডাক্তার সাহেব বললেন,আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝিনা। সময়ের কাজ সময়ে না করলে সবাইকে তার খেসারত দিতে হয়। ডাক্তার জিহানের হাতে রিপোর্ট দিয়ে বললেন,সরি আমাদের হাতের বাইরে। উনার ব্লাড ক্যানসার। সময় মাত্র চারদিন। জিহান রিপোর্ট হাতে নিয়ে না বলে চিৎকার করে উঠে। জিহানের চারিপাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসে।আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসে।
বাবার মৃত্যুর পর জিহান খুব ভেঙে পড়ে। জিহান ভেবে পাইনা সে এখন কী করবে। সংসার চালানো কত কষ্টের এখন সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। সে ভাবলো, আমাকে আরো শক্ত হতে হবে। ঈশ্বরকে বলে, হে ঈশ্বর, আমাকে ধৈর্য্য ধরার শক্তি দাও। কেননা দুটো ভাই-বোনকে মানুষ করতে হবে। আমি এখন ওদের বাবা- মা। একটার পর একটা কঠিন সমস্যা পার করে চলে সে।
এদিকে বাবার মৃত্যর পর তার কিছু টাকা এবং নিজের টিউশনিকে আকড়ে ধরে খুব কষ্টে সংসার চালাতে থাকে। রাতের আঁধারে বার বার বাবার কথা মনে করে কাঁদতে থাকে। বাবার প্রতি অবহেলা,
অনাদর বার বার তাকে দংশিত করে। এখন সে উপলব্ধি করতে পারে সংসারে বাবা- মাকে ভালো রাখার জন্য সন্তানের কতটা ভূমিকা দরকার। একটুখানি ভালবাসা,একটুখানি মায়ামমতা,একটুখানি হাসিমুখে রাখা,একটুখানি নিয়মিত খোঁজ -খবর নেওয়া,এতটুকুই চাওয়া তাদের। এই প্রাপ্তিটুকু যেন বাবা -মায়ের স্বর্গীয় উদ্যান।এতটুকু দিতে তো কোনো টাকা পয়সা লাগেনা। অথচ সেইটুকু দিতে আমরা কত কার্পণ্যবোধ করি। এসব ভাবে আর নিজেকে ধিক্কার দেয়। বাবা- মায়ের এক অপূরণীয় অভাব আকড়ে ধরে জিহানকে। সে ভাবে কিছু একটা করা দরকার। তাই জিহান সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের যুব সমাজকে নিয়ে সে একটা সংগঠন খুলবে। সে গ্রামের ১০জন শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে একটি সংগঠন খোলে। সবার সম্মতিতে সংগঠনটির নামকরণ করে “মানবিকতার পরিচর্যা”। সংগঠনের কতকগুলো শর্ত আরোপ করে প্রত্যেক সদস্যদের জন্য।উল্লেখ থাকে যে যারা শর্তগুলো মেনে আসবে শুধু তারাই সদস্য হতে পারবে।

শর্তগুলো হলো ঃ(১) কোনো অবস্থাতেই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের অবহেলা,অনাদরে কিংবা মানসিক কষ্টে রাখা যাবেনা।
(২) গ্রামের কারোর বৃদ্ধ বাবা- মা অসুস্থ হলে সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে সুস্থ্য করার দায়িত্ব নিতে হবে।
(৩)সপ্তাহে একদিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পূণর্মিলন অনুষ্ঠান করতে হবে। ঐ দিন তারা সারাদিন সবাই এক সাথে থাকবে। হাসি- আনন্দ,গল্প-গুজব তাদের ইচ্ছা মতোই চলবে। সারাদিনের খাবারের জন্য গ্রাম থেকে চাল- ডাল প্রয়োজনীয় জিনিস তুলতে হবে।
(৪)সংগঠন চালানোর জন্য প্রতিমাসে সদস্যদের চাঁদা কালেকশনে যেতে হবে।
(৫) গ্রামের সকল বাবা- মা হবে সবার আপন। আমার- তোমার চলবেনা। সপ্তাহে একদিন একটা ক্লাস করতে হবে,মানবিক,মুল্যবোধ জাগরণের ক্লাস। যাতে আমরা আর কোন বাবা- মাকে অকালমৃত্যুের দিকে ঠেলে না দিই।
(৬) প্রত্যেক বাড়িতে তদারকি করতে হবে। যদি কোন সন্তান তার বাবা- মাকে কষ্ট দেয় কিংবা অবহেলা বা অনাদরে রাখে অথবা তাদের সাথে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করে এবং কোনো প্রকার মানসিক কষ্টে রাখে আর সেটা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। চারিদিকে হৈ হৈ রৈরৈ পড়ে যায়। ব্যাপক সমর্থন পেতে শুরু করে। খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামটি শান্তির গ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

আজ জিহানের একটু হালকা লাগছে।মাথা থেকে যেন এক বিরাট বোঝা নেমে গেলো। আজ তাকে ভীষণ খুশী দেখাচ্ছে । সে বাবার কবরের কাছে গিয়ে বলল,বাবা দেখো, তোমার জিহান আজ কত বড় হয়ে গেছে। সে আজ দায়িত্ব নিতে শিখেছে। আর কোনো বাবা- মাকে কষ্ট পেতে হবেনা। তোমাদেরকে হারিয়ে আমি বুঝেছি কি মহামুল্য রত্ন হারিয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।কেন আমি আগে থেকে এই কাজটি করলাম না। তাহলে তোমাকে হয়ত হারাতে হত না। আজ তোমাকে হারিয়ে আমি নিঃশ্ব হয়ে গেছি বাবা। আমার বুকে বহে এক মরুভুমি হাহাকার। এক নিঃসঙ্গতার জীবন আমাকে কুরে কুরে খাই। সর্বত্রে খুঁজি তোমার মমতামাখা মুখখানা। তোমার সোনামুখটি ধরে খুব আদর করতে ইচ্ছে করে বাবা। তুমি হয়ত জানো না বাবা,তোমার অভাবে আমি ভেসে বেড়ায় এক অসীম শূন্যতায়।

পরিচিতি
শাহানাজ পারভীন শিউলী
আড়পাড়া, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
মোবাইল ঃ০১৭৯৬২৪৮৪৩৭
বাংলাদেশ।

Tag :

জনপ্রিয় সংবাদ

“মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন”

শূন্যতা

আপডেট টাইম ১১:৫৫:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০২২

শাহানাজ পারভীন শিউলী

খক খক করে কাশছে হাবিব সাহেব।বেশ কিছুদিন তার শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছেনা। গায়ে প্রচন্ড জ্বর।বমি বমি ভাব। তাই সে তিনদিন ছুটি নিলো।হাবিব সাহেব সুগার মিলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।তিন ছেলে-মেয়ে । বড় ছেলে জিহান বাংলায় অনার্স ১ম বর্ষ। মেজো ছেলে জিসান দশম শ্রেণিতে,ছোট মেয়ে জয়া সপ্তম শ্রেণিতে। স্ত্রী রোকেয়া পাঁচ বছর গত হয়েছেন রোড এক্সিডেন্ট এ। তারপর থেকে হাবিব সাহেব আর বিয়ে করেননি। তিন সন্তানকে বুকে আগলে রেখে সংসার করে যাচ্ছিলেন। যদিও স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

কলেজ থেকে জিহান বাসায় ফিরলো। বাবাকে দেখেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,কি হয়েছে বাবা? আজ তুমি অফিসে যাওনি?বাবা,বললেন,না।শরীরটা বেশ কিছুদিন ভাল যাচ্ছেনা। কই,আমাকে তো কিছুই বলোনি? বাবা বললেন,সামান্য জ্বর,ঠিক হয়ে যাবে তাই বলিনি। গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠলো জিহান। একি! গায়ে তো প্রচন্ড জ্বর! জিহান সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো।।ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে বললেন, এই ঔষধগুলো ঠিকমত খাওয়াবেন। সাতদিন পর নিয়ে আসবেন।

দিনে দিনে হাবিব সাহেবের শরীরের অবস্থা আরোও খারাপ হতে লাগলো। জিহানের দুঃচিন্তার কোনো শেষ নেই। মা বেঁচে নেই আজ পাঁচ বছর। বাবা কখনও আমাদের মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। আজ যদি বাবার কিছু হয়ে যায়——–।
কত কথা মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে জিহানের। নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছে। কেন বাবাকে এতদিন বোঝার চেষ্টা করিনি? কেন এক দিনও বুকে জড়িয়ে ধরে বলিনি, বাবা তুমি কেমন আছো? তার শূন্যতাকে কেন উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি? বটবৃক্ষের মতো তিনি নিজেকে উজাড় করে আমাদের মাথার উপর শীতল ছায়া দিয়ে গেছেন। নিজের বুকের উপর পাথর চেপে সুখী রেখেছেন, নীল বেদনাগুলো ঢেকে রেখে অধরের কোণে হাসি দিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেছেন, এগিয়ে চলো, এই তো আমি আছি তোমাদের সাথে। হাত দু,টি তার বড়ই সহানুভূতির, মমত্ববোধের,নির্ভরশীলতার। বার বার জিহান নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমি তো পারতাম বাবার কাঁধে হাতটা রাখতে। একটু সুখের কাজল মেখে দিতে।কখনও তো খেয়াল করিনি বাবার পায়ের স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেছে কিনা। শার্টের নীচের গেঞ্জিটা ছেড়া কিনা। বাবা সবাইকে যখন ঈদের পোশাক কিনে দিতো,তখন কখনও এসে বলিনি,বাবা তোমার পাঞ্জাবিটা কই? তোমার পছন্দের খাবারগুলো কি? কখনও তো জানতেও চায়নি। তার নির্ভরশীলতার জায়গাটা কখনও খোঁজার চেষ্টা করিনি। আর বাবা সব সময় আমাদের আবদার, চাহিদা পূরণ করে গেছেন। তিনি পরিবারের এতগুলো মানুষকে ভাল রেখেছেন আর আমরা সবাই মিলে একজন বাবাকে ভালো রাখতে পারেনি। বাবার শিয়রে বসে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছে আর ঈশ্বরকে ডাকছে। হে আমার ঈশ্বর, আর একবার সুযোগ দাও। বাবাকে সেবা করার, ভাল রাখার। আমি কথা দিচ্ছি, বাবা সেরে উঠলেই আমি তার দায়িত্ব নেবো। তাকে আর কষ্ট পেতে দেবো না। এসব বলছে আর বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ।

সকাল দশটাই ডাক্তার সাহেব জিহানের কাছে ফোন দিলো রিপোর্টগুলো নেওয়ার জন্য। জিহান রিপোর্ট আনতে গেলো। ডাক্তারের মুখ দেখেই জিহানের বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। জিহান ডাক্তারকে ধরে বলল, ডাক্তার সাহেব, বাবা ঠিক আছে তো? ডাক্তার সাহেব বললেন,আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝিনা। সময়ের কাজ সময়ে না করলে সবাইকে তার খেসারত দিতে হয়। ডাক্তার জিহানের হাতে রিপোর্ট দিয়ে বললেন,সরি আমাদের হাতের বাইরে। উনার ব্লাড ক্যানসার। সময় মাত্র চারদিন। জিহান রিপোর্ট হাতে নিয়ে না বলে চিৎকার করে উঠে। জিহানের চারিপাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসে।আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসে।
বাবার মৃত্যুর পর জিহান খুব ভেঙে পড়ে। জিহান ভেবে পাইনা সে এখন কী করবে। সংসার চালানো কত কষ্টের এখন সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। সে ভাবলো, আমাকে আরো শক্ত হতে হবে। ঈশ্বরকে বলে, হে ঈশ্বর, আমাকে ধৈর্য্য ধরার শক্তি দাও। কেননা দুটো ভাই-বোনকে মানুষ করতে হবে। আমি এখন ওদের বাবা- মা। একটার পর একটা কঠিন সমস্যা পার করে চলে সে।
এদিকে বাবার মৃত্যর পর তার কিছু টাকা এবং নিজের টিউশনিকে আকড়ে ধরে খুব কষ্টে সংসার চালাতে থাকে। রাতের আঁধারে বার বার বাবার কথা মনে করে কাঁদতে থাকে। বাবার প্রতি অবহেলা,
অনাদর বার বার তাকে দংশিত করে। এখন সে উপলব্ধি করতে পারে সংসারে বাবা- মাকে ভালো রাখার জন্য সন্তানের কতটা ভূমিকা দরকার। একটুখানি ভালবাসা,একটুখানি মায়ামমতা,একটুখানি হাসিমুখে রাখা,একটুখানি নিয়মিত খোঁজ -খবর নেওয়া,এতটুকুই চাওয়া তাদের। এই প্রাপ্তিটুকু যেন বাবা -মায়ের স্বর্গীয় উদ্যান।এতটুকু দিতে তো কোনো টাকা পয়সা লাগেনা। অথচ সেইটুকু দিতে আমরা কত কার্পণ্যবোধ করি। এসব ভাবে আর নিজেকে ধিক্কার দেয়। বাবা- মায়ের এক অপূরণীয় অভাব আকড়ে ধরে জিহানকে। সে ভাবে কিছু একটা করা দরকার। তাই জিহান সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের যুব সমাজকে নিয়ে সে একটা সংগঠন খুলবে। সে গ্রামের ১০জন শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে একটি সংগঠন খোলে। সবার সম্মতিতে সংগঠনটির নামকরণ করে “মানবিকতার পরিচর্যা”। সংগঠনের কতকগুলো শর্ত আরোপ করে প্রত্যেক সদস্যদের জন্য।উল্লেখ থাকে যে যারা শর্তগুলো মেনে আসবে শুধু তারাই সদস্য হতে পারবে।

শর্তগুলো হলো ঃ(১) কোনো অবস্থাতেই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের অবহেলা,অনাদরে কিংবা মানসিক কষ্টে রাখা যাবেনা।
(২) গ্রামের কারোর বৃদ্ধ বাবা- মা অসুস্থ হলে সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে সুস্থ্য করার দায়িত্ব নিতে হবে।
(৩)সপ্তাহে একদিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পূণর্মিলন অনুষ্ঠান করতে হবে। ঐ দিন তারা সারাদিন সবাই এক সাথে থাকবে। হাসি- আনন্দ,গল্প-গুজব তাদের ইচ্ছা মতোই চলবে। সারাদিনের খাবারের জন্য গ্রাম থেকে চাল- ডাল প্রয়োজনীয় জিনিস তুলতে হবে।
(৪)সংগঠন চালানোর জন্য প্রতিমাসে সদস্যদের চাঁদা কালেকশনে যেতে হবে।
(৫) গ্রামের সকল বাবা- মা হবে সবার আপন। আমার- তোমার চলবেনা। সপ্তাহে একদিন একটা ক্লাস করতে হবে,মানবিক,মুল্যবোধ জাগরণের ক্লাস। যাতে আমরা আর কোন বাবা- মাকে অকালমৃত্যুের দিকে ঠেলে না দিই।
(৬) প্রত্যেক বাড়িতে তদারকি করতে হবে। যদি কোন সন্তান তার বাবা- মাকে কষ্ট দেয় কিংবা অবহেলা বা অনাদরে রাখে অথবা তাদের সাথে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করে এবং কোনো প্রকার মানসিক কষ্টে রাখে আর সেটা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। চারিদিকে হৈ হৈ রৈরৈ পড়ে যায়। ব্যাপক সমর্থন পেতে শুরু করে। খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামটি শান্তির গ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

আজ জিহানের একটু হালকা লাগছে।মাথা থেকে যেন এক বিরাট বোঝা নেমে গেলো। আজ তাকে ভীষণ খুশী দেখাচ্ছে । সে বাবার কবরের কাছে গিয়ে বলল,বাবা দেখো, তোমার জিহান আজ কত বড় হয়ে গেছে। সে আজ দায়িত্ব নিতে শিখেছে। আর কোনো বাবা- মাকে কষ্ট পেতে হবেনা। তোমাদেরকে হারিয়ে আমি বুঝেছি কি মহামুল্য রত্ন হারিয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।কেন আমি আগে থেকে এই কাজটি করলাম না। তাহলে তোমাকে হয়ত হারাতে হত না। আজ তোমাকে হারিয়ে আমি নিঃশ্ব হয়ে গেছি বাবা। আমার বুকে বহে এক মরুভুমি হাহাকার। এক নিঃসঙ্গতার জীবন আমাকে কুরে কুরে খাই। সর্বত্রে খুঁজি তোমার মমতামাখা মুখখানা। তোমার সোনামুখটি ধরে খুব আদর করতে ইচ্ছে করে বাবা। তুমি হয়ত জানো না বাবা,তোমার অভাবে আমি ভেসে বেড়ায় এক অসীম শূন্যতায়।

পরিচিতি
শাহানাজ পারভীন শিউলী
আড়পাড়া, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
মোবাইল ঃ০১৭৯৬২৪৮৪৩৭
বাংলাদেশ।