ঢাকা ০৩:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
–গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা এলাকায় স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা মামলার পলাতক প্রধান আসামি শ্রী রুপেন দাশ’কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব । চন্দনাইশে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু ইষ্টার্ণ হাউজিংয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় সাংবাদিকদের উপর হামলা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কোরআন শরিফ অবমাননা করায় মানববন্ধন রাঙ্গুনিয়ায় সড়ক দূর্ঘটনার চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দিঘলিয়া উপজেলার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। চট্টগ্রামে সাতকানিয়ায় গভীর রাতে কৃষি জমির মাটি কাটার দায়ে দুইজনকে কারাদণ্ড … নড়াইলে মসজিদ ইমামের স্ত্রীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার, ভাড়াটিয়া পলাতক চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেছেন: প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা প্রচণ্ড দাবদাহে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের স্বস্তির উদ্যোগ।

মার্চে অভ্যুত্থানের বার্তা পান কিসিঞ্জার

নীল নদবিধৌত মনোরম নগরী আসওয়ান। হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যপ্রাচ্য ‘দৌড়ঝাঁপ কূটনীতি’র অন্যতম লীলাভূমি আনোয়ার সাদতের মিসর। ১৯৭৫ সালের মার্চ। কিসিঞ্জার আসওয়ানে এসেছেন। মরুভূমিতে তখন ধূলিঝড় নৈমিত্তিক। তাতে কিসিঞ্জারের গাড়িবহর একদিন এমনভাবেই পড়েছিল যে, তা থেকে উদ্ধারে মিসরীয় হেলিকপ্টার তলবের চিন্তা করতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশের বাতাস তখন মুজিব উৎখাতের ‘গুজবে’ ভারী হয়ে উঠেছে। সন্দেহাতীতভাবে কিসিঞ্জারের ওয়াশিংটনের কাছে তেমন খবরই ছিল।

১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি। সকাল ১০টা ২০। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন উপপ্রধান আরভিং চেসল ঢাকা থেকে পাঠানো ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ শীর্ষক তারবার্তায় লিখেছিলেন, ‘সামরিক অভ্যুত্থানসংক্রান্ত কিছু গুজব ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মার্চ হলো সবচেয়ে অনুকূল সময়। দেশের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশ সরকারের সামনে কোনো আশা নেই এবং কর্তৃত্ববাদের একটি বড় ডোজ গলাধঃকরণই এখন বঙ্গবন্ধুর জন্য অত্যন্ত লোভনীয় বিষয়।’

পঁচাত্তরের মার্চ মাসটাই কেন ও কীভাবে সবচেয়ে অনুকূল মনে হলো, তার উত্তর আমরা ওই তারবার্তায় পাই না। তবে এটা কাকতালীয় হলেও বিস্ময়কর যে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনএসসি) নির্দিষ্টভাবে সিআইএকে যুক্ত করে মার্চেই একটি দলিল তৈরি করল। তার শিরোনাম হলো ‘সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’। অবশ্য এর দ্বারা অভ্যুত্থানে সিআইএর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কোনো স্থির ধারণায় পৌঁছানো যায় না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএর জড়িত থাকার অভিযোগ মার্কিন প্রশাসন সব সময় দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করেই আসছে।

সাদত-কিসিঞ্জারের সখ্য
১৯৭১ সাল শেষ হয়ে এলে কিসিঞ্জারের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের আরও বিস্তৃতি ঘটেছিল। কিসিঞ্জার নিজেই লিখেছেন, ‘এর আগ পর্যন্ত আমি কেবল পরিকল্পনা, সতর্ককরণ, বিলম্বন এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কোনো বিষয়ে জোরাজুরি করে আলোচনা তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু প্রচণ্ড সংকটকাল ছাড়া নিজে নিজেই কূটনীতিটা সেরে ফেলতে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলাম না।’ [হোয়াইট হাউস ইয়ার্স, পৃ.৩৪৮ ]। এর মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে মহাক্ষমতাধর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ওপর কিসিঞ্জারের দাপট আরও বেড়ে গিয়েছিল।

তবে বাংলাদেশের কাছে আজও এটা অজ্ঞাত যে, আনোয়ার সাদত ঠিক কী ভূমিকা রেখেছিলেন। হয়তো কিসিঞ্জার বা তাঁর প্রশাসনের ইঙ্গিতেই ১৯৭৩ সালে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করার বিনিময়ে পাকিস্তানকে দিয়ে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর দেখি সাদতকে। তিনি ত্রিপক্ষীয় (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে) চুক্তিটা করাতে ইন্দিরা-মুজিব-ভুট্টোকে মিসরে নিতেও চেয়েছিলেন। সাদত কায়রো যেতে ইন্দিরার কাছে দূত পাঠালে তিনি তা নাকচ করেন।

আনোয়ার সাদতকে বাংলাদেশিরা কেবল এক রেজিমেন্ট ট্যাংক (৩২ টি) প্রদানের জন্য বেশি মনে রেখেছেন। কারণ মিসরীয় সেই গোলাবারুদবিহীন ফাঁকা ট্যাংকে চেপেই সৈয়দ ফারুক রহমান পঁচাত্তরের রক্তস্নাত বেদনাবিধুর অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৩ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পরে ব্যাংককে গিয়ে সৈয়দ ফারুক রহমান যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। কিসিঞ্জার খুনি চক্রের আবেদন ‘বিবেচনাধীন’ মর্মে বার্তাও পাঠান ব্যাংককে। কিন্তু ‘ওদের হাতে রক্ত’ বলে তাদের আশ্রয় দেওয়ার বিরোধিতা করে কিসিঞ্জারের কাছে বার্তা পাঠান বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতেরা। বাংলাদেশের বন্ধুখ্যাত সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিও সিনেটে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় প্রসঙ্গে কিসিঞ্জারের সম্ভাব্য পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন।

বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর অপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর যাতে বিচার না হতে পারে, সে জন্য হেনরি কিসিঞ্জার কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। পিকিংয়ে মাও সে-তুংকে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ১৯৫ জনের বিচার বাংলাদেশ যাতে না করতে পারে, সে জন্য বিষয়টি প্রয়োজনে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অংশে পরিণত করবেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে আনোয়ার সাদত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পক্ষে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশকে ট্যাংক প্রদান ও ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে বিনা বিচারে ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টিও সাদত এমন একটি প্রেক্ষাপটে করেছিলেন, যখন তিনি সোভিয়েতদের সঙ্গে তাঁর দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের কবর দিয়েছেন। হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন গোপন মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতে। সাদতের সঙ্গে পঁচাত্তরের ঘনিষ্ঠতা কিসিঞ্জারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্সে (কিসিঞ্জারের লেখা বই) মূর্ত: ‘আমার সরকারি কর্মজীবনে সম্ভবত আনোয়ার সাদত ছাড়া চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌএনলাইয়ের সঙ্গেই আমার আলোচনা ছিল দীর্ঘ ও গভীরতর।’

সাদতের স্বতঃপ্রণোদিত ট্যাংক উপহার
‘সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’। ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এই শিরোনামে একটি ‘সিক্রেট’ দলিল তৈরি হয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে এর প্রেরক: ‘এনইএ (ব্যুরো অব নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্স) এবং এনএসসি’। ২০ মার্চে ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ শীর্ষক আরেকটি তারবার্তা তৈরি করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ওই নথিটি মিসরের আসওয়ান সফররত কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ২০ মার্চে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী যোসেফ সিসকো আসওয়ানে ছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন জেরাল্ড ফোর্ড। ২০ মার্চ ১৯৭৫। বৃহস্পতিবার। এদিন রাত ১০টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কিসিঞ্জার সাদতের সঙ্গে বৈঠক করেন। পঁচাত্তরের ২১ মার্চ সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কিসিঞ্জার আসওয়ান ত্যাগ করেন। ২২ মার্চেই এনইএ ও এনএসসি তৈরি করেছিল সিআইএ ও অভ্যুত্থান শীর্ষক দলিলটি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ১০ নভেম্বর মিসরের আসওয়ান সফর করেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে ওই সময়ে হেনরি কিসিঞ্জারও মিসর সফর করছিলেন। কিসিঞ্জারের সফরের কারণে সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর সফরের কভারেজ কিছুটা ম্লান হয়েছিল বলেও সেখানকার তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলিটস ওয়াশিংটনকে অবহিত করেছিলেন।

১৯৭৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত বাংলাদেশ সফর করেন। সাদত তাঁর এই সফরকালেই বাংলাদেশকে ট্যাংক উপহারের ঘোষণা দেন।

এ বিষয়ে গত রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া শেষে সাদত লাহোর থেকে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে ট্যাংক চাননি। সাদতই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে ৩০টি ট্যাংক প্রদানে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। সাদত তাঁর দেশে ফিরেই এ বিষয়ে চিঠি দেন। সেই ট্যাংক আনতে জেনারেল শওকতকে পাঠানো হয়েছিল।’

‘সাদতের দেওয়া সেই ট্যাংকই আমাদের খেয়েছে’ গভীর বেদনার সঙ্গে বললেন বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব আহমেদ।

সাদতের ঢাকা সফরের মাত্র ৭৫ দিন পর বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ‘উচ্চতম পর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে’ শেখ মুজিবুর রহমান সরকার উৎখাতে মার্কিন সাহায্য চেয়ে ঢাকার তৎকালীন মার্কিন জনসংযোগ কর্মকর্তা গ্রেশামকে অনুরোধ করেন। ১৩ মে ফারুকের ওই তৎপরতার পাঁচ মাস পর চুয়াত্তরের অক্টোবরে কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফর করেন।

কী ছিল ওই বার্তায়
কিসিঞ্জারের কাছে মিসরের আসওয়ানে ২০ মার্চে পাঠানো তারবার্তাটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাফেজখানায় মাইক্রোফিল্ম হিসেবে রক্ষিত আছে। কিন্তু তার বিবরণ পাঠোদ্ধার করার আর সম্ভাবনা নেই মর্মে উল্লেখ আছে। এর বিষয় সম্পর্কে বলা আছে: ‘বৈদেশিক সম্পর্ক’, ‘সরকার উৎখাত’, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’। তারবার্তাটিতে দুটি সাংকেতিক শব্দও আছে। ‘ক্যাট-সি, টিওএসইসি ৮২৭ ’। এটি ২০০৬ সালের ৫ জুলাই সর্বসাধারণের জন্য অবমুক্ত করা হয়। এই দলিলটি অন্তত এটুকু নিশ্চিত করে যে,১৯৭৫ সালের মার্চে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সংঘটনের গুজব নিছক উড়ো কথা ছিল না। এবং তার চেয়েও বড় ইঙ্গিতবহ যে, হেনরি কিসিঞ্জার ব্যক্তিগতভাবেও বাংলাদেশে সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করতেন। আসওয়ান সফররত হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে ‘সিক্রেট’ বার্তায় ‘গুজব’ পৌঁছে দেওয়া কেবলই রুটিন হিসেবে গণ্য করা কঠিন।

আবার কারও কারও কাছে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এনইএ ও এনএসসি থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো তারবার্তার তারিখটি ইঙ্গিতবহ হয়ে ঠেকতে পারে। কারণ এর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেই বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মার্কিন নথি সাক্ষ্য দিচ্ছে সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের অগোচরে ১৯৭২ সালে ‘অস্ত্র ক্রয়ে’ মার্কিন দূতাবাসে যান। ১৯৭৩ সালের ১১ এপ্রিল ‘ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটির’ পক্ষে ফারুকের ভায়রা ভাই এবং অন্যতম খুনি মেজর রশীদ একইভাবে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র কেনার কথা বলে মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। এর আগে ২০০৯ সালের আগস্টে এই বিষয়টি প্রথম আলোতে ছাপা হলে এর ওপর আরটিভি একটি টক শো করে। তাতে প্রয়াত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর দাবি ছিল, এটা ভুয়া। সিআইএ এই নথি বানিয়েছে। আর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ওই কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। জিয়া ছিলেন উপপ্রধান। তবে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, জুনিয়র অফিসার ফারুক-রশীদকে অস্ত্র কিনতে মার্কিন মিশনে পাঠানোর কোনো প্রশ্নই আসে না।

জিয়ার সঙ্গে ফারুকের সাক্ষাৎ
সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহান্স, যিনি ফারুক-রশীদের পক্ষে তাঁর বইয়ে মিথ্যা সাফাই বক্তব্য দেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ: এ লিগেছি অব ব্লাড বইটির প্রকাশনা নিয়ে এরশাদ সরকারের আনুকূল্য থাকা বিষয়েও নানা কথা চালু ছিল।

ওই বইয়ে লরেন্স লিফশুলজের মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে খুনিদের ‘পূর্ব যোগাযোগের’ দাবি ম্যাসকারেনহান্স খণ্ডন করেন এই বলে যে, অভ্যুত্থানের আগে ফারুক-রশীদ কখনো মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেননি। তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চেষ্টা চালিয়ে ফারুক ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।’ আগেই বলেছি, এটি হচ্ছে সেই তারিখ যেদিন ফারুক জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবং মিসর সফররত কিসিঞ্জার বাংলাদেশে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের বার্তা পান।

উল্লেখ্য, ফারুক যখন জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মঈনকে জিয়ার বাসভবন ত্যাগ করতে দেখেন। জেনারেল মঈনুল ২০০০ সালে তাঁর প্রকাশিত বইয়ে (এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য) লেখেন, ‘পরদিন আমি অফিসে জেনারেল জিয়ার কাছে বিষয়টি তুলি। তিনি আমাকে বললেন, হ্যাঁ ফারুক এসেছিল। তিনি (জিয়া) এভাবে জুনিয়র অফিসারদের তাঁর বাড়িতে আসা নিরুৎসাহিত করতে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীদের বলে দিয়েছেন।’

ম্যাসকারেনহান্স অবশ্য লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়া যদিও চক্রান্তকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হননি। কিন্তু এটাও ঠিক যে তিনি ফারুককে গ্রেপ্তারও করেননি। উপরন্তু নিজেকে নিরাপদ রাখতে যখন তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তখন তিনি চক্রান্তের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখেন। ফারুকের বক্তব্য অনুযায়ী জিয়া তাঁর এডিসিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ফারুক যাতে আর কখনো তাঁর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করতে না পারেন।’

তবে পঁচাত্তরের মার্চের ওই তারবার্তাটি ছাড়াও একই মাসে প্রস্তুত হওয়া আমরা আরও চারটি অবমুক্ত হওয়া তারবার্তা পেয়েছি, যা থেকে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে ওই সময়ে অভ্যুত্থানের বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন দূতাবাসগুলো একপ্রকার জেগে ছিল। অবশ্য মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজকে ঢাকার তৎকালীন সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপি চেরি বলেছিলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখব না। কারণ কিছু ঘটলে আমাদেরই নাম পড়বে।’ (সূত্র: বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন)

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওয়াশিংটনে যোসেফ সিসকোর (নিক্সন সরকারের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি) উপস্থিতিতে কিসিঞ্জারের প্রশ্নের জবাবে আলফ্রেড আথারটন (সিসকোর সহকারী) বলেছেন, ‘মার্চে বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের বেশ কিছু পূর্ব লক্ষণ ছিল।’ এর একটি লক্ষণ যে পঁচাত্তরের ২২ মার্চ সিআইকে সম্পৃক্ত করা ওই তারবার্তাটি, সেটা ধারণা করা যায়।

এত দিন আমরা এটাই জানি যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান আর এন কাও বারবার বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিক মইনিহানের একটি নথি বলছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বছর আগে ভেবেছিল, বিভক্ত থাকার কারণে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মতো কিছু করার সম্ভাবনা কম

Tag :

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

–গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা এলাকায় স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা মামলার পলাতক প্রধান আসামি শ্রী রুপেন দাশ’কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব ।

মার্চে অভ্যুত্থানের বার্তা পান কিসিঞ্জার

আপডেট টাইম ০৬:০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অগাস্ট ২০১৮

নীল নদবিধৌত মনোরম নগরী আসওয়ান। হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যপ্রাচ্য ‘দৌড়ঝাঁপ কূটনীতি’র অন্যতম লীলাভূমি আনোয়ার সাদতের মিসর। ১৯৭৫ সালের মার্চ। কিসিঞ্জার আসওয়ানে এসেছেন। মরুভূমিতে তখন ধূলিঝড় নৈমিত্তিক। তাতে কিসিঞ্জারের গাড়িবহর একদিন এমনভাবেই পড়েছিল যে, তা থেকে উদ্ধারে মিসরীয় হেলিকপ্টার তলবের চিন্তা করতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশের বাতাস তখন মুজিব উৎখাতের ‘গুজবে’ ভারী হয়ে উঠেছে। সন্দেহাতীতভাবে কিসিঞ্জারের ওয়াশিংটনের কাছে তেমন খবরই ছিল।

১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি। সকাল ১০টা ২০। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন উপপ্রধান আরভিং চেসল ঢাকা থেকে পাঠানো ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ শীর্ষক তারবার্তায় লিখেছিলেন, ‘সামরিক অভ্যুত্থানসংক্রান্ত কিছু গুজব ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মার্চ হলো সবচেয়ে অনুকূল সময়। দেশের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশ সরকারের সামনে কোনো আশা নেই এবং কর্তৃত্ববাদের একটি বড় ডোজ গলাধঃকরণই এখন বঙ্গবন্ধুর জন্য অত্যন্ত লোভনীয় বিষয়।’

পঁচাত্তরের মার্চ মাসটাই কেন ও কীভাবে সবচেয়ে অনুকূল মনে হলো, তার উত্তর আমরা ওই তারবার্তায় পাই না। তবে এটা কাকতালীয় হলেও বিস্ময়কর যে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনএসসি) নির্দিষ্টভাবে সিআইএকে যুক্ত করে মার্চেই একটি দলিল তৈরি করল। তার শিরোনাম হলো ‘সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’। অবশ্য এর দ্বারা অভ্যুত্থানে সিআইএর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কোনো স্থির ধারণায় পৌঁছানো যায় না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএর জড়িত থাকার অভিযোগ মার্কিন প্রশাসন সব সময় দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করেই আসছে।

সাদত-কিসিঞ্জারের সখ্য
১৯৭১ সাল শেষ হয়ে এলে কিসিঞ্জারের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের আরও বিস্তৃতি ঘটেছিল। কিসিঞ্জার নিজেই লিখেছেন, ‘এর আগ পর্যন্ত আমি কেবল পরিকল্পনা, সতর্ককরণ, বিলম্বন এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কোনো বিষয়ে জোরাজুরি করে আলোচনা তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু প্রচণ্ড সংকটকাল ছাড়া নিজে নিজেই কূটনীতিটা সেরে ফেলতে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলাম না।’ [হোয়াইট হাউস ইয়ার্স, পৃ.৩৪৮ ]। এর মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে মহাক্ষমতাধর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ওপর কিসিঞ্জারের দাপট আরও বেড়ে গিয়েছিল।

তবে বাংলাদেশের কাছে আজও এটা অজ্ঞাত যে, আনোয়ার সাদত ঠিক কী ভূমিকা রেখেছিলেন। হয়তো কিসিঞ্জার বা তাঁর প্রশাসনের ইঙ্গিতেই ১৯৭৩ সালে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করার বিনিময়ে পাকিস্তানকে দিয়ে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর দেখি সাদতকে। তিনি ত্রিপক্ষীয় (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে) চুক্তিটা করাতে ইন্দিরা-মুজিব-ভুট্টোকে মিসরে নিতেও চেয়েছিলেন। সাদত কায়রো যেতে ইন্দিরার কাছে দূত পাঠালে তিনি তা নাকচ করেন।

আনোয়ার সাদতকে বাংলাদেশিরা কেবল এক রেজিমেন্ট ট্যাংক (৩২ টি) প্রদানের জন্য বেশি মনে রেখেছেন। কারণ মিসরীয় সেই গোলাবারুদবিহীন ফাঁকা ট্যাংকে চেপেই সৈয়দ ফারুক রহমান পঁচাত্তরের রক্তস্নাত বেদনাবিধুর অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৩ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পরে ব্যাংককে গিয়ে সৈয়দ ফারুক রহমান যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। কিসিঞ্জার খুনি চক্রের আবেদন ‘বিবেচনাধীন’ মর্মে বার্তাও পাঠান ব্যাংককে। কিন্তু ‘ওদের হাতে রক্ত’ বলে তাদের আশ্রয় দেওয়ার বিরোধিতা করে কিসিঞ্জারের কাছে বার্তা পাঠান বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতেরা। বাংলাদেশের বন্ধুখ্যাত সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিও সিনেটে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় প্রসঙ্গে কিসিঞ্জারের সম্ভাব্য পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন।

বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর অপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর যাতে বিচার না হতে পারে, সে জন্য হেনরি কিসিঞ্জার কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। পিকিংয়ে মাও সে-তুংকে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ১৯৫ জনের বিচার বাংলাদেশ যাতে না করতে পারে, সে জন্য বিষয়টি প্রয়োজনে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অংশে পরিণত করবেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে আনোয়ার সাদত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পক্ষে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশকে ট্যাংক প্রদান ও ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে বিনা বিচারে ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টিও সাদত এমন একটি প্রেক্ষাপটে করেছিলেন, যখন তিনি সোভিয়েতদের সঙ্গে তাঁর দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের কবর দিয়েছেন। হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন গোপন মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতে। সাদতের সঙ্গে পঁচাত্তরের ঘনিষ্ঠতা কিসিঞ্জারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্সে (কিসিঞ্জারের লেখা বই) মূর্ত: ‘আমার সরকারি কর্মজীবনে সম্ভবত আনোয়ার সাদত ছাড়া চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌএনলাইয়ের সঙ্গেই আমার আলোচনা ছিল দীর্ঘ ও গভীরতর।’

সাদতের স্বতঃপ্রণোদিত ট্যাংক উপহার
‘সিআইএ এবং বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’। ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এই শিরোনামে একটি ‘সিক্রেট’ দলিল তৈরি হয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে এর প্রেরক: ‘এনইএ (ব্যুরো অব নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্স) এবং এনএসসি’। ২০ মার্চে ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ শীর্ষক আরেকটি তারবার্তা তৈরি করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ওই নথিটি মিসরের আসওয়ান সফররত কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ২০ মার্চে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী যোসেফ সিসকো আসওয়ানে ছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন জেরাল্ড ফোর্ড। ২০ মার্চ ১৯৭৫। বৃহস্পতিবার। এদিন রাত ১০টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কিসিঞ্জার সাদতের সঙ্গে বৈঠক করেন। পঁচাত্তরের ২১ মার্চ সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কিসিঞ্জার আসওয়ান ত্যাগ করেন। ২২ মার্চেই এনইএ ও এনএসসি তৈরি করেছিল সিআইএ ও অভ্যুত্থান শীর্ষক দলিলটি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ১০ নভেম্বর মিসরের আসওয়ান সফর করেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে ওই সময়ে হেনরি কিসিঞ্জারও মিসর সফর করছিলেন। কিসিঞ্জারের সফরের কারণে সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর সফরের কভারেজ কিছুটা ম্লান হয়েছিল বলেও সেখানকার তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলিটস ওয়াশিংটনকে অবহিত করেছিলেন।

১৯৭৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত বাংলাদেশ সফর করেন। সাদত তাঁর এই সফরকালেই বাংলাদেশকে ট্যাংক উপহারের ঘোষণা দেন।

এ বিষয়ে গত রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া শেষে সাদত লাহোর থেকে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে ট্যাংক চাননি। সাদতই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে ৩০টি ট্যাংক প্রদানে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। সাদত তাঁর দেশে ফিরেই এ বিষয়ে চিঠি দেন। সেই ট্যাংক আনতে জেনারেল শওকতকে পাঠানো হয়েছিল।’

‘সাদতের দেওয়া সেই ট্যাংকই আমাদের খেয়েছে’ গভীর বেদনার সঙ্গে বললেন বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব আহমেদ।

সাদতের ঢাকা সফরের মাত্র ৭৫ দিন পর বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ‘উচ্চতম পর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে’ শেখ মুজিবুর রহমান সরকার উৎখাতে মার্কিন সাহায্য চেয়ে ঢাকার তৎকালীন মার্কিন জনসংযোগ কর্মকর্তা গ্রেশামকে অনুরোধ করেন। ১৩ মে ফারুকের ওই তৎপরতার পাঁচ মাস পর চুয়াত্তরের অক্টোবরে কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফর করেন।

কী ছিল ওই বার্তায়
কিসিঞ্জারের কাছে মিসরের আসওয়ানে ২০ মার্চে পাঠানো তারবার্তাটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাফেজখানায় মাইক্রোফিল্ম হিসেবে রক্ষিত আছে। কিন্তু তার বিবরণ পাঠোদ্ধার করার আর সম্ভাবনা নেই মর্মে উল্লেখ আছে। এর বিষয় সম্পর্কে বলা আছে: ‘বৈদেশিক সম্পর্ক’, ‘সরকার উৎখাত’, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’। তারবার্তাটিতে দুটি সাংকেতিক শব্দও আছে। ‘ক্যাট-সি, টিওএসইসি ৮২৭ ’। এটি ২০০৬ সালের ৫ জুলাই সর্বসাধারণের জন্য অবমুক্ত করা হয়। এই দলিলটি অন্তত এটুকু নিশ্চিত করে যে,১৯৭৫ সালের মার্চে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সংঘটনের গুজব নিছক উড়ো কথা ছিল না। এবং তার চেয়েও বড় ইঙ্গিতবহ যে, হেনরি কিসিঞ্জার ব্যক্তিগতভাবেও বাংলাদেশে সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করতেন। আসওয়ান সফররত হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে ‘সিক্রেট’ বার্তায় ‘গুজব’ পৌঁছে দেওয়া কেবলই রুটিন হিসেবে গণ্য করা কঠিন।

আবার কারও কারও কাছে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এনইএ ও এনএসসি থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো তারবার্তার তারিখটি ইঙ্গিতবহ হয়ে ঠেকতে পারে। কারণ এর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেই বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মার্কিন নথি সাক্ষ্য দিচ্ছে সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের অগোচরে ১৯৭২ সালে ‘অস্ত্র ক্রয়ে’ মার্কিন দূতাবাসে যান। ১৯৭৩ সালের ১১ এপ্রিল ‘ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটির’ পক্ষে ফারুকের ভায়রা ভাই এবং অন্যতম খুনি মেজর রশীদ একইভাবে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র কেনার কথা বলে মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। এর আগে ২০০৯ সালের আগস্টে এই বিষয়টি প্রথম আলোতে ছাপা হলে এর ওপর আরটিভি একটি টক শো করে। তাতে প্রয়াত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর দাবি ছিল, এটা ভুয়া। সিআইএ এই নথি বানিয়েছে। আর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ওই কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। জিয়া ছিলেন উপপ্রধান। তবে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, জুনিয়র অফিসার ফারুক-রশীদকে অস্ত্র কিনতে মার্কিন মিশনে পাঠানোর কোনো প্রশ্নই আসে না।

জিয়ার সঙ্গে ফারুকের সাক্ষাৎ
সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহান্স, যিনি ফারুক-রশীদের পক্ষে তাঁর বইয়ে মিথ্যা সাফাই বক্তব্য দেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ: এ লিগেছি অব ব্লাড বইটির প্রকাশনা নিয়ে এরশাদ সরকারের আনুকূল্য থাকা বিষয়েও নানা কথা চালু ছিল।

ওই বইয়ে লরেন্স লিফশুলজের মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে খুনিদের ‘পূর্ব যোগাযোগের’ দাবি ম্যাসকারেনহান্স খণ্ডন করেন এই বলে যে, অভ্যুত্থানের আগে ফারুক-রশীদ কখনো মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেননি। তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চেষ্টা চালিয়ে ফারুক ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।’ আগেই বলেছি, এটি হচ্ছে সেই তারিখ যেদিন ফারুক জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবং মিসর সফররত কিসিঞ্জার বাংলাদেশে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের বার্তা পান।

উল্লেখ্য, ফারুক যখন জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মঈনকে জিয়ার বাসভবন ত্যাগ করতে দেখেন। জেনারেল মঈনুল ২০০০ সালে তাঁর প্রকাশিত বইয়ে (এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য) লেখেন, ‘পরদিন আমি অফিসে জেনারেল জিয়ার কাছে বিষয়টি তুলি। তিনি আমাকে বললেন, হ্যাঁ ফারুক এসেছিল। তিনি (জিয়া) এভাবে জুনিয়র অফিসারদের তাঁর বাড়িতে আসা নিরুৎসাহিত করতে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীদের বলে দিয়েছেন।’

ম্যাসকারেনহান্স অবশ্য লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়া যদিও চক্রান্তকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হননি। কিন্তু এটাও ঠিক যে তিনি ফারুককে গ্রেপ্তারও করেননি। উপরন্তু নিজেকে নিরাপদ রাখতে যখন তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তখন তিনি চক্রান্তের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখেন। ফারুকের বক্তব্য অনুযায়ী জিয়া তাঁর এডিসিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ফারুক যাতে আর কখনো তাঁর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করতে না পারেন।’

তবে পঁচাত্তরের মার্চের ওই তারবার্তাটি ছাড়াও একই মাসে প্রস্তুত হওয়া আমরা আরও চারটি অবমুক্ত হওয়া তারবার্তা পেয়েছি, যা থেকে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে ওই সময়ে অভ্যুত্থানের বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন দূতাবাসগুলো একপ্রকার জেগে ছিল। অবশ্য মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজকে ঢাকার তৎকালীন সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপি চেরি বলেছিলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখব না। কারণ কিছু ঘটলে আমাদেরই নাম পড়বে।’ (সূত্র: বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন)

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওয়াশিংটনে যোসেফ সিসকোর (নিক্সন সরকারের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি) উপস্থিতিতে কিসিঞ্জারের প্রশ্নের জবাবে আলফ্রেড আথারটন (সিসকোর সহকারী) বলেছেন, ‘মার্চে বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের বেশ কিছু পূর্ব লক্ষণ ছিল।’ এর একটি লক্ষণ যে পঁচাত্তরের ২২ মার্চ সিআইকে সম্পৃক্ত করা ওই তারবার্তাটি, সেটা ধারণা করা যায়।

এত দিন আমরা এটাই জানি যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান আর এন কাও বারবার বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিক মইনিহানের একটি নথি বলছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বছর আগে ভেবেছিল, বিভক্ত থাকার কারণে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মতো কিছু করার সম্ভাবনা কম