ঢাকা ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
রোজা মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত করে-লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল। গজারিয়া বালুয়াকান্দি ইউনিয়নে সিকদার পরিবারে আমিরুল ইসলাম এর সর্মথনে আলোচনা সভা ও ইফতার দোয়া মাহফিল চসিকের ৬ ষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের ৩৮ তম সাধারণ সভায় মশা কমাতে কার্যক্রম বাড়াবে : মেয়র রেজাউল “বিড়ি শিল্পে ট্যাক্স প্রত্যাহারসহ চার দাবিতে রংপুর শ্রমিকদের মানববন্ধন” ইন্দুরকানী প্রেসক্লাবে ইফতার মাহফিল বরিশাল চকবাজার এবায়দুল্লাহ মসজিদে অগ্নিকান্ড। টাঙ্গাইলে দৈনিক সকালের সময় পত্রিকার পাঠক ফোরাম গঠিত চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই চক্রের ৫ সদস্য গ্রেপ্তার চট্টগ্রামে জালনোটসহ প্রতারকচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ রমজান মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘন করছে নারায়ণগঞ্জ চিশতিয়া বাউল সমিত

বৃষ্টি আর দোলা কোথায় হারালেন?

মাতৃভূমির খবর ডেস্ক : ফাতেমা-তুজ-জোহরা (বৃষ্টি) ও রেহনুমা তাবাসসুম (দোলা)—সংস্কৃতিকর্মী দুই বন্ধুকে অগ্নিকাণ্ডের ছয় মিনিট আগে নন্দকুমার দত্ত গলিতে দেখা গেছে একটি ভিডিও ফুটেজে। এই গলিই এসে মিশেছে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের রাত থেকে নিখোঁজ এই দুই বন্ধু। কেউ জানে না ঠিক কী ঘটেছে তাঁদের ভাগ্যে।

গতকাল মঙ্গলবার বৃষ্টি ও দোলার পরিবার ভিডিও ফুটেজটি দেখেছে। চকবাজার থানার উল্টো দিকের গলিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিসি ক্যামেরায় ওই ফুটেজ রক্ষিত আছে বলে জানিয়েছেন দুই পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা দেখেছেন, দুই বন্ধু এগোচ্ছেন রিকশায়। হাসিমুখে দোলা কিছু একটা বলছেন বন্ধুকে। দুজনেরই কোলের ওপর ব্যাগ। পরনে শাড়ি। ঘড়িতে সময় তখন রাত ১০টা বেজে ২৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ১০টা ৩১ মিনিটে।

বৃষ্টি ও দোলার বন্ধুত্ব শৈশব থেকেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন পড়তেন, তখন থেকে একসঙ্গে আছেন দুজনে। উচ্চমাধ্যমিকের পর বৃষ্টি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে ভর্তি হন। আর দোলা ভর্তি হন আইন বিভাগে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। দুজনেই যুক্ত ছিলেন আবৃত্তি সংগঠনে। দোলার বাসা পুরান ঢাকার আমতলীতে। বৃষ্টির বাসা পোস্তায়। ২০ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান শেষে দুজনে বাড়ির পথ ধরেছিলেন একই সঙ্গে। বৃষ্টির সঙ্গে মা শামসুন্নাহারের কথা হয়েছিল ৯টায়। আর দোলার সঙ্গে বাবা দলিলুর রহমানের কথা হয়েছিল ৯টা ৪১ মিনিটে। ঘড়ির কাঁটায় ঘুরপাক খাচ্ছে দুই পরিবারের সন্তানদের সব হিসাবনিকাশ।

ভিডিও ফুটেজটি দেখার পর দুই বন্ধুর পরিবারের প্রতিক্রিয়া দুরকম। পুরান ঢাকার পোস্তা ফাঁড়ির কাছে যে বাসাটিতে বৃষ্টি তাঁর বাবা–মা আর ছোট দুই ভাইবোনের সঙ্গে থাকতেন, তার বাইরে থেকে কাল শোনা যাচ্ছিল আর্তনাদের শব্দ। বৃষ্টির মা শামসুন্নাহারকে ধরে রাখতে পারছিলেন না তাঁর ভাইয়েরা। তিনি শুধু চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি কত গরিব। আল্লাহ এই দুনিয়ায় কত গরিব করে পাঠিয়েছে আমাকে। মেয়েটাকে শেষ সময়ের কাপড়টাও দিতে পারলাম না। পুড়ে ছাই হয়ে গেল!’

দোলার মা সুফিয়া রহমান কিছু বলছেন না। বাবা দলিলুর রহমান শেষ ছয় মিনিটে তাঁর মেয়ে গলিপথের কোনো ফাঁকফোকর ধরে অন্য কোনো পথে উঠে যেতে পেরেছিল কি না, সেই হিসাব কষছেন দিনভর। তিনি বলছিলেন, ‘আমার হাতে এখনো ছয় মিনিট সময় আছে। ওরা হয়তো রিকশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছে, যেটা ফুটেজে নেই। অনেক কিছুই ঘটতে পারে। অলৌকিক বলে কি কিছু নেই? কত দেখেছি দুর্ঘটনায় সবাই মারা গেছে, একজন বা দুজন বেঁচে গেছে। আমি হয়তো সেই ভাগ্যবান মানুষ।’ দলিলুর বলছিলেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের মর্গে ঘুরে এসেছেন। দোলাকে পাননি। তাঁরা ডিএনএ নমুনা দিয়ে এসেছেন। নমুনা মিলে গেলে তিনি মেনে নেবেন তাঁর মেয়ে নেই। তার আগ পর্যন্ত তিনি অন্য কিছু ভাবতে চান না। তিনি মনে করেন, এত বড় অন্যায় তাঁর সঙ্গে কিছুতেই হতে পারে না।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, মর্গে আসা মৃতদেহগুলোর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি ছিল নারীদেহ। এর মধ্যে দুটি মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি তিনটি এখনো শনাক্ত করা যায়নি।

লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুবাস কুমার পাল  বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আশঙ্কা হচ্ছে, বৃষ্টি–দোলা অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়েছিলেন। তাঁরা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান শেষে মৎস্য ভবন দিয়ে চানখাঁরপুল হয়ে চকবাজারের দিকে আসছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির কারণে শহীদ মিনারের দিককার পথ বন্ধ থাকায় তাঁরা হয়তো বিকল্প পথ ধরেছিলেন। দুই বন্ধুর একজনের বাসাও চকবাজার লাগোয়া।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মামুন হোসেন জানান, তাঁরা গলিপথের ৫৫ সেকেন্ডের ফুটেজ পেয়েছেন। সেখানেই দুজনকে দেখা গেছে। এই পথের শেষেই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাঁরা মনে করছেন, দুই বন্ধুর নিখোঁজ রহস্যের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।

জানা গেছে, তদন্ত শেষ পর্যায়ে এ কথাটা পুলিশ জানিয়েছে দোলার বাবা দলিলুর রহমান ও মা সুফিয়া রহমানকেও। দলিলুর মানতে রাজি নন। তিনি বলছেন, তদন্ত কেবল শুরু। ছয় মিনিটের ফয়সালা এখনো হয়নি। তিনি বরং এখন যাঁরা প্রতারণা করে দুই পরিবারের কাছ থেকে মেয়েদের সন্ধান দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের খোঁজা জরুরি বলে মনে করেন। দলিলুর  বলছিলেন, ‘আমার থেকে প্রতারকেরা ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ চায়। তখনই বুঝেছি দোলা ওদের কাছে নেই। দোলা আমার পৃথিবী। এক পৃথিবীর দাম কি কখনো এত কম হয়?’

সূত্র : প্রথম আলো

Tag :

জনপ্রিয় সংবাদ

রোজা মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত করে-লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল।

বৃষ্টি আর দোলা কোথায় হারালেন?

আপডেট টাইম ০৫:৫৪:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

মাতৃভূমির খবর ডেস্ক : ফাতেমা-তুজ-জোহরা (বৃষ্টি) ও রেহনুমা তাবাসসুম (দোলা)—সংস্কৃতিকর্মী দুই বন্ধুকে অগ্নিকাণ্ডের ছয় মিনিট আগে নন্দকুমার দত্ত গলিতে দেখা গেছে একটি ভিডিও ফুটেজে। এই গলিই এসে মিশেছে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের রাত থেকে নিখোঁজ এই দুই বন্ধু। কেউ জানে না ঠিক কী ঘটেছে তাঁদের ভাগ্যে।

গতকাল মঙ্গলবার বৃষ্টি ও দোলার পরিবার ভিডিও ফুটেজটি দেখেছে। চকবাজার থানার উল্টো দিকের গলিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিসি ক্যামেরায় ওই ফুটেজ রক্ষিত আছে বলে জানিয়েছেন দুই পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা দেখেছেন, দুই বন্ধু এগোচ্ছেন রিকশায়। হাসিমুখে দোলা কিছু একটা বলছেন বন্ধুকে। দুজনেরই কোলের ওপর ব্যাগ। পরনে শাড়ি। ঘড়িতে সময় তখন রাত ১০টা বেজে ২৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ১০টা ৩১ মিনিটে।

বৃষ্টি ও দোলার বন্ধুত্ব শৈশব থেকেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন পড়তেন, তখন থেকে একসঙ্গে আছেন দুজনে। উচ্চমাধ্যমিকের পর বৃষ্টি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে ভর্তি হন। আর দোলা ভর্তি হন আইন বিভাগে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। দুজনেই যুক্ত ছিলেন আবৃত্তি সংগঠনে। দোলার বাসা পুরান ঢাকার আমতলীতে। বৃষ্টির বাসা পোস্তায়। ২০ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান শেষে দুজনে বাড়ির পথ ধরেছিলেন একই সঙ্গে। বৃষ্টির সঙ্গে মা শামসুন্নাহারের কথা হয়েছিল ৯টায়। আর দোলার সঙ্গে বাবা দলিলুর রহমানের কথা হয়েছিল ৯টা ৪১ মিনিটে। ঘড়ির কাঁটায় ঘুরপাক খাচ্ছে দুই পরিবারের সন্তানদের সব হিসাবনিকাশ।

ভিডিও ফুটেজটি দেখার পর দুই বন্ধুর পরিবারের প্রতিক্রিয়া দুরকম। পুরান ঢাকার পোস্তা ফাঁড়ির কাছে যে বাসাটিতে বৃষ্টি তাঁর বাবা–মা আর ছোট দুই ভাইবোনের সঙ্গে থাকতেন, তার বাইরে থেকে কাল শোনা যাচ্ছিল আর্তনাদের শব্দ। বৃষ্টির মা শামসুন্নাহারকে ধরে রাখতে পারছিলেন না তাঁর ভাইয়েরা। তিনি শুধু চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি কত গরিব। আল্লাহ এই দুনিয়ায় কত গরিব করে পাঠিয়েছে আমাকে। মেয়েটাকে শেষ সময়ের কাপড়টাও দিতে পারলাম না। পুড়ে ছাই হয়ে গেল!’

দোলার মা সুফিয়া রহমান কিছু বলছেন না। বাবা দলিলুর রহমান শেষ ছয় মিনিটে তাঁর মেয়ে গলিপথের কোনো ফাঁকফোকর ধরে অন্য কোনো পথে উঠে যেতে পেরেছিল কি না, সেই হিসাব কষছেন দিনভর। তিনি বলছিলেন, ‘আমার হাতে এখনো ছয় মিনিট সময় আছে। ওরা হয়তো রিকশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছে, যেটা ফুটেজে নেই। অনেক কিছুই ঘটতে পারে। অলৌকিক বলে কি কিছু নেই? কত দেখেছি দুর্ঘটনায় সবাই মারা গেছে, একজন বা দুজন বেঁচে গেছে। আমি হয়তো সেই ভাগ্যবান মানুষ।’ দলিলুর বলছিলেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের মর্গে ঘুরে এসেছেন। দোলাকে পাননি। তাঁরা ডিএনএ নমুনা দিয়ে এসেছেন। নমুনা মিলে গেলে তিনি মেনে নেবেন তাঁর মেয়ে নেই। তার আগ পর্যন্ত তিনি অন্য কিছু ভাবতে চান না। তিনি মনে করেন, এত বড় অন্যায় তাঁর সঙ্গে কিছুতেই হতে পারে না।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, মর্গে আসা মৃতদেহগুলোর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি ছিল নারীদেহ। এর মধ্যে দুটি মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি তিনটি এখনো শনাক্ত করা যায়নি।

লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুবাস কুমার পাল  বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আশঙ্কা হচ্ছে, বৃষ্টি–দোলা অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়েছিলেন। তাঁরা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান শেষে মৎস্য ভবন দিয়ে চানখাঁরপুল হয়ে চকবাজারের দিকে আসছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির কারণে শহীদ মিনারের দিককার পথ বন্ধ থাকায় তাঁরা হয়তো বিকল্প পথ ধরেছিলেন। দুই বন্ধুর একজনের বাসাও চকবাজার লাগোয়া।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মামুন হোসেন জানান, তাঁরা গলিপথের ৫৫ সেকেন্ডের ফুটেজ পেয়েছেন। সেখানেই দুজনকে দেখা গেছে। এই পথের শেষেই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাঁরা মনে করছেন, দুই বন্ধুর নিখোঁজ রহস্যের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।

জানা গেছে, তদন্ত শেষ পর্যায়ে এ কথাটা পুলিশ জানিয়েছে দোলার বাবা দলিলুর রহমান ও মা সুফিয়া রহমানকেও। দলিলুর মানতে রাজি নন। তিনি বলছেন, তদন্ত কেবল শুরু। ছয় মিনিটের ফয়সালা এখনো হয়নি। তিনি বরং এখন যাঁরা প্রতারণা করে দুই পরিবারের কাছ থেকে মেয়েদের সন্ধান দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের খোঁজা জরুরি বলে মনে করেন। দলিলুর  বলছিলেন, ‘আমার থেকে প্রতারকেরা ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ চায়। তখনই বুঝেছি দোলা ওদের কাছে নেই। দোলা আমার পৃথিবী। এক পৃথিবীর দাম কি কখনো এত কম হয়?’

সূত্র : প্রথম আলো