ঢাকা ০৪:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
গজারিয়ায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান দুই প্রতিষ্ঠান কে অর্থদন্ড টেকপাড়া ও ইয়াকুব নগরের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্হদের মাঝে নগর অর্থ ও বস্ত্র বিতরণ বাস ও ফুটওভার ব্রিজ মুখোমুখি সংঘর্ষ “২৬শে এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে শার্ক ট্যাংক বাংলাদেশ” –মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর এলাকা হতে ৫৩ কেজি গাঁজাসহ ০৩ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০; মাদক বহনে ব্যবহৃত পিকআপ জব্দ। “মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন” ইন্দুরকানীতে দিনব্যাপী পারিবারিক পুষ্টি বাগান ও বস্তায় আদা চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে চুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন … লালমনিরহাটে বৃষ্টির জন‍্য বিশেষ নামাজ আদায় মিছিল ও শোডাউন করায় মতলব উত্তর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মানিক দর্জিকে শোকজ

কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা।

আঃ মজিদ খান, পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধিঃ
গোপালগঞ্জে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে বিজয়ের পর ট্রফি হাতে কিশোর বঙ্গবন্ধু। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লিতে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা যেমন বর্ণিল, তেমনি চমকপ্রদ। ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ ছোটবেলায় ছিলেন দুরন্ত বালক। গ্রামের কাদা-জল, মেঠো পথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদি কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তার কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখকের গবেষকদের লেখনিতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে। নানা শেখ আবদুল মজিদ আদরের নাতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান রাখলেও বাবা-মার কাছে ছিলেন ‘খোকা’। আজ তার ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। সরকারে দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করছে।
বঙ্গবন্ধু নিজে ‘দুষ্ট বালক’ ছিলেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এমন তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম।
পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সবার আদর পাওয়ার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।”
কন্যা শেখ হাসিনার এক লেখায় জাতির পিতা এভাবে উঠে এসেছেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগতো। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তার কথামতো যা বলতেন তাই করতো। এই পোষা পাখি, জীব-জন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না।
খেলাধুলা, পাখি ধরা, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও তিনি সে সময় বাড়িতে খুব পড়াশোনাও করতেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তিনি নিয়মিতই পড়তেন। বাড়িতে বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। এসবই সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা। সে সময়ের শিক্ষিত পরিবার মাত্রই এসব পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন। ছোটবেলা থেকে এসব পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে ছোট্ট মুজিবের সামনে বিপুলা পৃথিবীর এক দরাজ দরজা খুলে গিয়েছিল।
কিশোর বয়সে বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’
কন্যা শেখ হাসিনার লেখা এবং বিভিন্ন বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর খেলাধুলার তথ্য উঠে এসেছে। তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন বলেও শেখ হাসিনা বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান অনেক সময় বঙ্গবন্ধুর খেলা দেখতেও যেতেন। হালকা-পাতলা দেহী বঙ্গবন্ধু কখনও বলে লাথি মেরে গড়িয়েও পড়তেন। এসব গল্প শেখ হাসিনার দাদা হাস্যরস করে বাড়িতে বলতেন বলে শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে তিনি লিখেছেন, আমার আব্বার লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে, ‘তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে, বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়তো। আব্বা যদি ধারে কাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো মাঝে মাঝে আব্বার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো।
স্বভাবে দুরন্ত হলেও ছোটবেলায় নানা রোগও তাকে কম ভোগায়নি। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা হওয়ায় চিকিৎসা নিতে হয়েছিল কলকাতায়। অস্ত্রোপচারের পর চোখে উঠেছিল চশমা। চোখের অসুখের কারণে বেশ কিছুদিন পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পরে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি।
যে বয়সটা দুরন্তপনার, সে সময়ই সংসারজীবনে পা রাখতে হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “…নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবো।’
“রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাই-বোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। গত শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যেই স্বদেশী আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোনও কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। …ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।
পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন শেখ মুজিব। সারাজীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতির ভক্ত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তরুণ বঙ্গবন্ধু।
গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের। ছেলেবেলাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তার সারাজীবনেরই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে এটা খুব বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া তাঁর নেতৃত্বে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলাপ ওই সময়ই।
“হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাকে সংবর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।” ওই আলাপের পর শেখ মুজিবের নাম-ঠিকানা লিখে নেন সোহরাওয়ার্দী। পরে কিশোর মুজিবুর রহমানকে চিঠিও লেখেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। চলে পত্র যোগাযোগ। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চে গণতন্ত্রের সংগ্রামে গুরু-শিষ্যের এক অনন্য যুগলবন্দি।
ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু মানবদরদি ও হৃদয়বান ছিলেন। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করতো। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতো। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংকপাড়ায়, আব্বা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদির কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ আর কিছুই নয়, কোন ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ, রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাকে ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন। দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’
তিনি যে দরিদ্র মানুষের বিপন্নতায় বিচলিত হতেন, তার প্রমাণ মেলে ছোটবেলার আরেকটি ঘটনায়। ‘একবার তার গ্রামের চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষকদের জীবনে নেমে আসে অভাব-অনটন। অনেক বাড়িতেই দুবেলা ভাত রান্না বন্ধ হয়ে যায়। চাষিদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। তাদের সন্তানরা অভুক্ত। সারা গ্রামেই প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে চাপা গুঞ্জন। কিশোর মুজিব এ রকম পরিস্থিতিতে দুঃখ-ভারাক্রান্ত। কিন্তু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একটা কিছু করার জন্য তিনি ছটফট করছিলেন। সে সময় যে পথটি তার সামনে খোলা ছিল, তিনি তাই করলেন। নিজের পিতাকে তিনি তাদের গোলা থেকে বিপন্ন কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের জন্য অনুরোধ জানালেন। তাদের নিজেদের ধানের মজুত কেমন, এই অনুরোধ তার বাবা রাখতে পারবেন কিনা, সেসব তিনি ভাবেননি। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটিই ছিল তখন তার কাছে মুখ্য।’
এমন আরও অনেক ঘটনার সমারোহে বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর কেটেছে। মুজিব তার পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। এ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাবার কাছে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘একবার বর্ষাকালে নৌকা করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমার আব্বা খালের পানিতে পড়ে যান। এর পর আমার দাদি তাকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। আর একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল, তার এতটুকু কষ্ট যেন সকলেরই কষ্ট!’
বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগী হিসেবে এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই শিক্ষক মারা গেলে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেবা সমিতির ভার নেন এবং অনেক দিন পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আরেক শিক্ষক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একথাগুলো বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন।###

Tag :

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

গজারিয়ায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান দুই প্রতিষ্ঠান কে অর্থদন্ড

কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা।

আপডেট টাইম ০৯:১১:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ মার্চ ২০২৩

আঃ মজিদ খান, পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধিঃ
গোপালগঞ্জে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে বিজয়ের পর ট্রফি হাতে কিশোর বঙ্গবন্ধু। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লিতে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা যেমন বর্ণিল, তেমনি চমকপ্রদ। ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ ছোটবেলায় ছিলেন দুরন্ত বালক। গ্রামের কাদা-জল, মেঠো পথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদি কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তার কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখকের গবেষকদের লেখনিতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে। নানা শেখ আবদুল মজিদ আদরের নাতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান রাখলেও বাবা-মার কাছে ছিলেন ‘খোকা’। আজ তার ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। সরকারে দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করছে।
বঙ্গবন্ধু নিজে ‘দুষ্ট বালক’ ছিলেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এমন তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম।
পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সবার আদর পাওয়ার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।”
কন্যা শেখ হাসিনার এক লেখায় জাতির পিতা এভাবে উঠে এসেছেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগতো। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তার কথামতো যা বলতেন তাই করতো। এই পোষা পাখি, জীব-জন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না।
খেলাধুলা, পাখি ধরা, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও তিনি সে সময় বাড়িতে খুব পড়াশোনাও করতেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তিনি নিয়মিতই পড়তেন। বাড়িতে বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। এসবই সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা। সে সময়ের শিক্ষিত পরিবার মাত্রই এসব পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন। ছোটবেলা থেকে এসব পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে ছোট্ট মুজিবের সামনে বিপুলা পৃথিবীর এক দরাজ দরজা খুলে গিয়েছিল।
কিশোর বয়সে বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’
কন্যা শেখ হাসিনার লেখা এবং বিভিন্ন বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর খেলাধুলার তথ্য উঠে এসেছে। তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন বলেও শেখ হাসিনা বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান অনেক সময় বঙ্গবন্ধুর খেলা দেখতেও যেতেন। হালকা-পাতলা দেহী বঙ্গবন্ধু কখনও বলে লাথি মেরে গড়িয়েও পড়তেন। এসব গল্প শেখ হাসিনার দাদা হাস্যরস করে বাড়িতে বলতেন বলে শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে তিনি লিখেছেন, আমার আব্বার লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে, ‘তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে, বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়তো। আব্বা যদি ধারে কাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো মাঝে মাঝে আব্বার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো।
স্বভাবে দুরন্ত হলেও ছোটবেলায় নানা রোগও তাকে কম ভোগায়নি। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা হওয়ায় চিকিৎসা নিতে হয়েছিল কলকাতায়। অস্ত্রোপচারের পর চোখে উঠেছিল চশমা। চোখের অসুখের কারণে বেশ কিছুদিন পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পরে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি।
যে বয়সটা দুরন্তপনার, সে সময়ই সংসারজীবনে পা রাখতে হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “…নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবো।’
“রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাই-বোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। গত শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যেই স্বদেশী আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোনও কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। …ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।
পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন শেখ মুজিব। সারাজীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতির ভক্ত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তরুণ বঙ্গবন্ধু।
গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের। ছেলেবেলাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তার সারাজীবনেরই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে এটা খুব বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া তাঁর নেতৃত্বে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলাপ ওই সময়ই।
“হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাকে সংবর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।” ওই আলাপের পর শেখ মুজিবের নাম-ঠিকানা লিখে নেন সোহরাওয়ার্দী। পরে কিশোর মুজিবুর রহমানকে চিঠিও লেখেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। চলে পত্র যোগাযোগ। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চে গণতন্ত্রের সংগ্রামে গুরু-শিষ্যের এক অনন্য যুগলবন্দি।
ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু মানবদরদি ও হৃদয়বান ছিলেন। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করতো। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতো। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংকপাড়ায়, আব্বা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদির কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ আর কিছুই নয়, কোন ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ, রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাকে ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন। দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’
তিনি যে দরিদ্র মানুষের বিপন্নতায় বিচলিত হতেন, তার প্রমাণ মেলে ছোটবেলার আরেকটি ঘটনায়। ‘একবার তার গ্রামের চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষকদের জীবনে নেমে আসে অভাব-অনটন। অনেক বাড়িতেই দুবেলা ভাত রান্না বন্ধ হয়ে যায়। চাষিদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। তাদের সন্তানরা অভুক্ত। সারা গ্রামেই প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে চাপা গুঞ্জন। কিশোর মুজিব এ রকম পরিস্থিতিতে দুঃখ-ভারাক্রান্ত। কিন্তু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একটা কিছু করার জন্য তিনি ছটফট করছিলেন। সে সময় যে পথটি তার সামনে খোলা ছিল, তিনি তাই করলেন। নিজের পিতাকে তিনি তাদের গোলা থেকে বিপন্ন কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের জন্য অনুরোধ জানালেন। তাদের নিজেদের ধানের মজুত কেমন, এই অনুরোধ তার বাবা রাখতে পারবেন কিনা, সেসব তিনি ভাবেননি। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটিই ছিল তখন তার কাছে মুখ্য।’
এমন আরও অনেক ঘটনার সমারোহে বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর কেটেছে। মুজিব তার পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। এ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাবার কাছে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘একবার বর্ষাকালে নৌকা করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমার আব্বা খালের পানিতে পড়ে যান। এর পর আমার দাদি তাকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। আর একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল, তার এতটুকু কষ্ট যেন সকলেরই কষ্ট!’
বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগী হিসেবে এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই শিক্ষক মারা গেলে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেবা সমিতির ভার নেন এবং অনেক দিন পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আরেক শিক্ষক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একথাগুলো বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন।###