ঢাকা ০৯:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
–অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা হতে ০৪ জন পরিবহন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০। চট্টগ্রামে দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে-২ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা বিএমএর হকার আর যত্রতত্র আবর্জনা কমাতে অভিযানের ঘোষণা মেয়র রেজাউলের রামগঞ্জে প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী ২০২৪ অনুষ্ঠিত। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন পরিবর্তনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন গজারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে দিনভর গনসংযোগ ও লিফলেট বিতরন গজারিয়ায় নারী উদ্যোক্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত পুলিশের বিশেষ অভিযানে ভয়ঙ্কর ডাকাত সর্দার মামুন গ্রেফতার বগুড়ায় অবকাশ হোটেলে অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ৯ জন খরিদ্দারকে দুই দিনের কারাদণ্ড দিলেন আদালত নানা বাড়ি বেড়াতে এসে নদীতে ডুবে কিশোর কিশোরীর মৃত্যু

অশান্তি জারি কাশ্মীরে, জওয়ানদের চোখে প্রতিশোধের আগুন

মাতৃভূমির খবর ডেস্ক : হিমালয়ের কোলে তুলোর মতো সাদা বরফে ঢাকা ছোট্ট বাবাগুন্ড গ্রামে তখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। তার মাঝেই এক সিআরপিএফ জওয়ানের এ হেন চিলচিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। যে হুঁশিয়ার-বাণী পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আপনি এখানে এলেন কী ভাবে?

ততক্ষণে মোবাইল ফোন চলে গিয়েছে সিআরপিএফের জিম্মায়। সেকেন্ডের মধ্যে খুলে ফেলা হল ব্যাটারি। সিম কার্ড। ভাগ্য ভাল যে, মেমোরি চিপ ছিল না ভেতরে। না হলে কপালে কী দুর্গতি লেখা থাকত কে জানে! মোবাইলের ভাল করে শুধু পরীক্ষা হল না, গত এক-দেড় ঘণ্টায় কী কী ছবি বা ভিডিও তোলা হয়েছে খুলে সব দেখাতে হল। সিআরপিএফ জওয়ানদের আগ্রাসন এতটাই যে, প্রেস কার্ড দেখিয়েও শান্ত করা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত শ্রীনগর সিআরপিএফ-এর এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের সঙ্গে গত কয়েক দিনের মেসেজ হিস্ট্রি দেখানোর পর যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। সঙ্গে প্রায় মুচলেকা দেওয়ার মতো বলতে হল, “আপনাদের নিষেধ আছে এমন কোনও কাজ করব না।” কিছু করার নেই। এটা তো সেই বাবাগুন্ড গ্রাম যেখানে দুই জঙ্গিকে নিকেশ করতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে পাঁচ-ছ’জনের। আহত দশেরও বেশি। দেখা গেল, সামান্যতম ঝুঁকিও নিতে রাজি নন জওয়ানরা।

শ্যেন দৃষ্টিতে সমানে যেন বডি স্ক্যান চলছে। বোঝার চেষ্টা চলছে, নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি টপকে মিডিয়া এত দূর এসে পৌঁছল কী ভাবে? তারই মধ্যে কোনও মতে জিজ্ঞাসা করা গেল, এখন পরিস্থিতি কী রকম? নতুন কোনও আপডেট আছে? খর দৃষ্টিতে এক অফিসার বললেন, “জায়গাটা যে কর্ডন করে রাখা হয়েছে, দেখতেই তো পাচ্ছেন। কয়েকটা টিম এখনও সার্চ অপারেশন চালাচ্ছে। জানি না আদৌ সব জঙ্গিকে শেষ করা গিয়েছে, নাকি এখনও কেউ কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। কেন নিজের বিপদ বাড়াচ্ছেন? তাড়াতাড়ি নেমে যান।” সঙ্গের ড্রাইভারকে ততক্ষণে নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখনই নেমে যাও। মুখ ঘোরাও গাড়ির। পাশ থেকে আর এক জওয়ান উৎকণ্ঠা সমেত বললেন, “আপনারা নেমে যান। এখানে যা কিছু যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে!” সত্যি বলতে কী, বাবাগুন্ড গ্রামে ঢুকতে পারার কথাই ছিল না। সেনাবাহিনীর তরফে সে রকমই বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে। হান্দওয়ারার কাছাকাছি পৌঁছে জনা কয়েক বিএসএফ জওয়ানকে দেখে গাড়ির ড্রাইভার জানতে চেয়েছিলেন, অকুস্থল ঠিক কোন দিকে পড়বে? একজন স্পষ্ট অস্বীকার করলেন। বললেন, এখানে কিছুই হয়নি। আর একজন একটা রাস্তা দেখালেন বটে। শুধু সেটা উল্টো! সেনাবাহিনী যে ঠিকানা দিতে অনিচ্ছুক সেটা বুঝতে পেরে কি না কে জানে, গাড়ির ড্রাইভার আঁকাবাঁকা পথ ধরলেন।

এনকাউন্টার জোনে পৌঁছনোর ভেতরের রাস্তা। সেখানে পৌঁছে জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলা গেল মেরেকেটে মিনিট পাঁচেক। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে, জীবনের কঠিনতম পাঁচ মিনিট। এতটাই ঠাণ্ডা চাহনি। এতটাই জ্বলন্ত সেই চোখের ভাষা। যা অনবরত বার্তা দিচ্ছে, এখান থেকে হঠো। এটা ফুলের বাগান নয়। সাক্ষাৎ যমরাজ্য! শেষ পর্যন্ত নামতে হল জওয়ানদের কথা মতো। কিন্তু আবার বাধা! নতুন করে জওয়ানদের থেকে নয়। পাহাড়ি রাস্তায় বাঁক নেওয়ার মুখে এবার ঘিরে ধরলেন স্থানীয় দশ-বারো জন। না, তাঁরা ‘পাথরবাজ’ নন। গাড়িতে লেগে থাকা প্রেস স্টিকার এবং উপর থেকে নামতে দেখে এঁরা এগিয়ে এসেছেন এবং ড্রাইভারকে স্থানীয় বুঝে শুরু হল ‘কোশুর’ শুরু হল একের পর এক প্রশ্ন। পরে ড্রাইভার বলছিলেন যে, উপরের পরিস্থিতি জানতে চাইছিলেন স্থানীয়রা। কারণ, শনিবার সকালেও নাকি উপরে গোলাগুলির শব্দ শোনা গিয়েছে। অভিনন্দন, পাকিস্তান, যুদ্ধ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলাম ড্রাইভারকে। স্থানীয়রদের কথাবার্তার নির্যাস যা শোনা গেল তা এ রকম, ‘‘জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যাদের বেঁচে থাকতে হয়, তাদের অন্যকিছু আর শুনতে ভাল লাগে না। ভাবতেও না। রুটি-নাস্তার মতো নিজের প্রাণরক্ষাও তাঁদের প্রতি মুহূর্তের ভাবনা। কেউ কেউ অবশ্য জীবনের অন্য স্বপ্নও দেখান। কিন্তু তাঁরা কেউই সমাজ-স্বীকৃত নেতা নন!’’

অথচ সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য রকম ভাবে। ঠিক ছিল, যাওয়া হবে কুপওয়ারা। যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা আগে শ’য়ে—শ’য়ে গুলি চলেছে। ব্রেকফাস্ট মিটিয়ে সকাল সকাল রওনা দেওয়া গেল। মাঝ রাত থেকেই অল্প অল্প করে পড়া বরফ ভিজিয়ে দিয়েছে গোটা উপত্যকাকে। বোলভার্ড রোড হয়ে বাটামাল্লু চক থেকে ডান দিকে এক নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগোতে এগোতে, জাহালিম নদীর ভাঙাচোরা ব্রিজ টপকে পাট্টানে এক চায়ের দোকানে আলাপ হল কৃষ্ণনগরের বিনয় ঘোষের সঙ্গে। তিন বছর কাশ্মীরে মোতায়েন বিএসএফ জওয়ান। অথচ তাঁর পোস্টিং কোথায়, জানেন শুধু দেড় বছর আগে বিয়ে হওয়া স্ত্রী। পাছে মা-বাবা চিন্তা করেন, তাই কিছু বলেননি! কথাপ্রসঙ্গে বাবাগুন্ড এনকাউন্টার প্রসঙ্গ উঠতে বললেন, “এ তো রোজই হয়।” আর তার পর? তার পর বাবাগুন্ড পৌঁছে কী হল না হল, পূর্বে বর্ণিত। ফেরার পথে কেমন যেন ঘোর-ঘোর লাগছিল। তখনও যেন কানে বাজছিল সেই গগনভেদী চিৎকার, ‘আপ ইয়াহা তক আয়ে ক্যায়সে?’

সকাল থেকে ঘটে চলা ঘটনার প্রভাব এতটাই যে রাস্তার ধারের দু’পাশের উইলো, আপেল গাছের সৌন্দর্য উপভোগের প্রশ্নই নেই। আপেলগাছগুলো এখন শুকনো। শুনলাম, মরশুম শুরু হবে সেপ্টেম্বরে। ফিরতে ফিরতে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের লাংগেট পোস্ট পড়ল। নেমে খোঁজ নিলাম, স্থানীয় পুলিশের কাছে কোনও খবরাখবর আছে কি না। শুনলাম, দায়িত্বে থাকা সাব ইন্সপেক্টর জান মহম্মদ সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। শুক্রবারও নাকি কাকভোরে বেরিয়ে ফিরেছেন রাত দশটায়। তা হলে কি এই এলাকায় এখনও অনেক কিছু হওয়ার বাকি? উত্তর নেই। কিন্তু যথেষ্ট ইঙ্গিত আছে। শ্রীনগরে নেমে আসছি যখন, উল্টোদিক থেকে উপরে উঠছে একের পর এক সেনা কনভয়। ড্রাইভারের মাথার দিকে বন্দুক তাক করে তাকিয়ে থাকা চোখগুলোয় যেন জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। প্রথমে গাড়ির সংখ্যা গোনার চেষ্টা করছিলাম। শেষে হাল ছেড়ে দিলাম। কাশ্মীরের আপেলগাছ তো আগামী সেপ্টেম্বরে ফের জীবন্ত হবে। শুকনো থেকে হবে সজীব। কিন্তু কাশ্মীর—সে আবার জীবনে ফিরবে কবে থেকে? কোন মাসে?

Tag :

জনপ্রিয় সংবাদ

–অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা হতে ০৪ জন পরিবহন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০।

অশান্তি জারি কাশ্মীরে, জওয়ানদের চোখে প্রতিশোধের আগুন

আপডেট টাইম ০৪:২৪:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ মার্চ ২০১৯

মাতৃভূমির খবর ডেস্ক : হিমালয়ের কোলে তুলোর মতো সাদা বরফে ঢাকা ছোট্ট বাবাগুন্ড গ্রামে তখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। তার মাঝেই এক সিআরপিএফ জওয়ানের এ হেন চিলচিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। যে হুঁশিয়ার-বাণী পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আপনি এখানে এলেন কী ভাবে?

ততক্ষণে মোবাইল ফোন চলে গিয়েছে সিআরপিএফের জিম্মায়। সেকেন্ডের মধ্যে খুলে ফেলা হল ব্যাটারি। সিম কার্ড। ভাগ্য ভাল যে, মেমোরি চিপ ছিল না ভেতরে। না হলে কপালে কী দুর্গতি লেখা থাকত কে জানে! মোবাইলের ভাল করে শুধু পরীক্ষা হল না, গত এক-দেড় ঘণ্টায় কী কী ছবি বা ভিডিও তোলা হয়েছে খুলে সব দেখাতে হল। সিআরপিএফ জওয়ানদের আগ্রাসন এতটাই যে, প্রেস কার্ড দেখিয়েও শান্ত করা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত শ্রীনগর সিআরপিএফ-এর এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের সঙ্গে গত কয়েক দিনের মেসেজ হিস্ট্রি দেখানোর পর যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। সঙ্গে প্রায় মুচলেকা দেওয়ার মতো বলতে হল, “আপনাদের নিষেধ আছে এমন কোনও কাজ করব না।” কিছু করার নেই। এটা তো সেই বাবাগুন্ড গ্রাম যেখানে দুই জঙ্গিকে নিকেশ করতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে পাঁচ-ছ’জনের। আহত দশেরও বেশি। দেখা গেল, সামান্যতম ঝুঁকিও নিতে রাজি নন জওয়ানরা।

শ্যেন দৃষ্টিতে সমানে যেন বডি স্ক্যান চলছে। বোঝার চেষ্টা চলছে, নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি টপকে মিডিয়া এত দূর এসে পৌঁছল কী ভাবে? তারই মধ্যে কোনও মতে জিজ্ঞাসা করা গেল, এখন পরিস্থিতি কী রকম? নতুন কোনও আপডেট আছে? খর দৃষ্টিতে এক অফিসার বললেন, “জায়গাটা যে কর্ডন করে রাখা হয়েছে, দেখতেই তো পাচ্ছেন। কয়েকটা টিম এখনও সার্চ অপারেশন চালাচ্ছে। জানি না আদৌ সব জঙ্গিকে শেষ করা গিয়েছে, নাকি এখনও কেউ কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। কেন নিজের বিপদ বাড়াচ্ছেন? তাড়াতাড়ি নেমে যান।” সঙ্গের ড্রাইভারকে ততক্ষণে নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখনই নেমে যাও। মুখ ঘোরাও গাড়ির। পাশ থেকে আর এক জওয়ান উৎকণ্ঠা সমেত বললেন, “আপনারা নেমে যান। এখানে যা কিছু যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে!” সত্যি বলতে কী, বাবাগুন্ড গ্রামে ঢুকতে পারার কথাই ছিল না। সেনাবাহিনীর তরফে সে রকমই বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে। হান্দওয়ারার কাছাকাছি পৌঁছে জনা কয়েক বিএসএফ জওয়ানকে দেখে গাড়ির ড্রাইভার জানতে চেয়েছিলেন, অকুস্থল ঠিক কোন দিকে পড়বে? একজন স্পষ্ট অস্বীকার করলেন। বললেন, এখানে কিছুই হয়নি। আর একজন একটা রাস্তা দেখালেন বটে। শুধু সেটা উল্টো! সেনাবাহিনী যে ঠিকানা দিতে অনিচ্ছুক সেটা বুঝতে পেরে কি না কে জানে, গাড়ির ড্রাইভার আঁকাবাঁকা পথ ধরলেন।

এনকাউন্টার জোনে পৌঁছনোর ভেতরের রাস্তা। সেখানে পৌঁছে জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলা গেল মেরেকেটে মিনিট পাঁচেক। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে, জীবনের কঠিনতম পাঁচ মিনিট। এতটাই ঠাণ্ডা চাহনি। এতটাই জ্বলন্ত সেই চোখের ভাষা। যা অনবরত বার্তা দিচ্ছে, এখান থেকে হঠো। এটা ফুলের বাগান নয়। সাক্ষাৎ যমরাজ্য! শেষ পর্যন্ত নামতে হল জওয়ানদের কথা মতো। কিন্তু আবার বাধা! নতুন করে জওয়ানদের থেকে নয়। পাহাড়ি রাস্তায় বাঁক নেওয়ার মুখে এবার ঘিরে ধরলেন স্থানীয় দশ-বারো জন। না, তাঁরা ‘পাথরবাজ’ নন। গাড়িতে লেগে থাকা প্রেস স্টিকার এবং উপর থেকে নামতে দেখে এঁরা এগিয়ে এসেছেন এবং ড্রাইভারকে স্থানীয় বুঝে শুরু হল ‘কোশুর’ শুরু হল একের পর এক প্রশ্ন। পরে ড্রাইভার বলছিলেন যে, উপরের পরিস্থিতি জানতে চাইছিলেন স্থানীয়রা। কারণ, শনিবার সকালেও নাকি উপরে গোলাগুলির শব্দ শোনা গিয়েছে। অভিনন্দন, পাকিস্তান, যুদ্ধ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলাম ড্রাইভারকে। স্থানীয়রদের কথাবার্তার নির্যাস যা শোনা গেল তা এ রকম, ‘‘জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যাদের বেঁচে থাকতে হয়, তাদের অন্যকিছু আর শুনতে ভাল লাগে না। ভাবতেও না। রুটি-নাস্তার মতো নিজের প্রাণরক্ষাও তাঁদের প্রতি মুহূর্তের ভাবনা। কেউ কেউ অবশ্য জীবনের অন্য স্বপ্নও দেখান। কিন্তু তাঁরা কেউই সমাজ-স্বীকৃত নেতা নন!’’

অথচ সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য রকম ভাবে। ঠিক ছিল, যাওয়া হবে কুপওয়ারা। যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা আগে শ’য়ে—শ’য়ে গুলি চলেছে। ব্রেকফাস্ট মিটিয়ে সকাল সকাল রওনা দেওয়া গেল। মাঝ রাত থেকেই অল্প অল্প করে পড়া বরফ ভিজিয়ে দিয়েছে গোটা উপত্যকাকে। বোলভার্ড রোড হয়ে বাটামাল্লু চক থেকে ডান দিকে এক নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগোতে এগোতে, জাহালিম নদীর ভাঙাচোরা ব্রিজ টপকে পাট্টানে এক চায়ের দোকানে আলাপ হল কৃষ্ণনগরের বিনয় ঘোষের সঙ্গে। তিন বছর কাশ্মীরে মোতায়েন বিএসএফ জওয়ান। অথচ তাঁর পোস্টিং কোথায়, জানেন শুধু দেড় বছর আগে বিয়ে হওয়া স্ত্রী। পাছে মা-বাবা চিন্তা করেন, তাই কিছু বলেননি! কথাপ্রসঙ্গে বাবাগুন্ড এনকাউন্টার প্রসঙ্গ উঠতে বললেন, “এ তো রোজই হয়।” আর তার পর? তার পর বাবাগুন্ড পৌঁছে কী হল না হল, পূর্বে বর্ণিত। ফেরার পথে কেমন যেন ঘোর-ঘোর লাগছিল। তখনও যেন কানে বাজছিল সেই গগনভেদী চিৎকার, ‘আপ ইয়াহা তক আয়ে ক্যায়সে?’

সকাল থেকে ঘটে চলা ঘটনার প্রভাব এতটাই যে রাস্তার ধারের দু’পাশের উইলো, আপেল গাছের সৌন্দর্য উপভোগের প্রশ্নই নেই। আপেলগাছগুলো এখন শুকনো। শুনলাম, মরশুম শুরু হবে সেপ্টেম্বরে। ফিরতে ফিরতে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের লাংগেট পোস্ট পড়ল। নেমে খোঁজ নিলাম, স্থানীয় পুলিশের কাছে কোনও খবরাখবর আছে কি না। শুনলাম, দায়িত্বে থাকা সাব ইন্সপেক্টর জান মহম্মদ সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। শুক্রবারও নাকি কাকভোরে বেরিয়ে ফিরেছেন রাত দশটায়। তা হলে কি এই এলাকায় এখনও অনেক কিছু হওয়ার বাকি? উত্তর নেই। কিন্তু যথেষ্ট ইঙ্গিত আছে। শ্রীনগরে নেমে আসছি যখন, উল্টোদিক থেকে উপরে উঠছে একের পর এক সেনা কনভয়। ড্রাইভারের মাথার দিকে বন্দুক তাক করে তাকিয়ে থাকা চোখগুলোয় যেন জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। প্রথমে গাড়ির সংখ্যা গোনার চেষ্টা করছিলাম। শেষে হাল ছেড়ে দিলাম। কাশ্মীরের আপেলগাছ তো আগামী সেপ্টেম্বরে ফের জীবন্ত হবে। শুকনো থেকে হবে সজীব। কিন্তু কাশ্মীর—সে আবার জীবনে ফিরবে কবে থেকে? কোন মাসে?