ঢাকা ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ১৬ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
“নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে তথ্যমন্ত্রীর শোক” “দেশে ইসলাম এসেছে শান্তির পথে : তথ্যমন্ত্রী” সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো, মুরাদনগরে মামুন মিয়ার বাড়ি চলছে মাতম নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে নতুনধারার শোক গজারিয়া টেংগারচর ইউনিয়নের বড়ইকান্দি ভাটেরচর গ্রামে অল্প বৃষ্টিতে সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি মধ্য বাড্ডা হাজী রুস্তম আলী ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ড– (প্রানহানির ঘটনা ঘটে নাই) বিএনইজি ও এমজেসিবি’র উদ্যোগে ইফতারের খাদ্য সামগ্রী বিতরন — “এক-এগারোর কুশীলবরা ও বিএনপি একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করছে : তথ্যমন্ত্রী” রমজানের সওগাত সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক- আ জ ম নাছির উদ্দীন ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ অবশেষে প্রতারক চক্রের ৪(চার) সদস্য আটক।

আমি চাইলাম যারে…

আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বাউল সাধক কফিলউদ্দিনের মৃতুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করে এই লেখা।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জনপদ আধ্যাত্মিক নগর সিলেট। সুফি, মরমি, বৈষ্ণব, সাধু, ফকিরেরা এ অঞ্চলকে করেছেন গরীয়ান। কালোত্তীর্ণ এই তীর্থভূমির সুপুরুষদেরই একজন কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর রচিত প্রায় পাঁচ হাজার গানের মধ্যে জনপ্রিয় একটি হলো-‘আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে, সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে।’

প্রান্তিক জনপদেও সাধক বা মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। যাঁরা জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণের বার্তা দিয়েছেন কবিতায়, গানের বাণীতে। এমনই এক সাধক কবি ‘জ্ঞানের সাগর’ খ্যাত দুরবিন শাহের অন্যতম শিষ্য কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান কণ্ঠে তুলে খ্যাতি অর্জন করেছেন বহু কণ্ঠশিল্পী। তবু সিলেটের বাইরে তিনি রয়ে গেলেন অচেনা, অজানা। এক হাতে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাকে। ঠোঁটের সাহায্যে তাঁর মন্দিরা বাজানোর দৃশ্যে হৃদয়ে দাগ কাটে। অল্প সময়ে যেকোনো বিষয়ে গান লিখে দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।

১৯৩২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের মালঞ্চপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, মা করিমুন্নেসা। এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০ বছর বয়স থেকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

শিশুকাল থেকে রাত জেগে পালাগান শুনতে শুনতেই গানের জগতে প্রবেশ। যৌবনের সন্ধিক্ষণে গান লিখতে শুরু করেন। একতারা, দোতারা বাজিয়ে গাইতেন নিজের এবং বিভিন্ন মহাজনি গান। যৌবনকালে আখমাড়াইয়ের মেশিনে বাঁ হাতটি থেঁতলে যায়, কেটে ফেলতে হয় কনুই পর্যন্ত। বহু দুঃখ-দুর্দশায় জীবন কাটালেও থেমে থাকেনি তাঁর কণ্ঠ। শাহ আবদুল করিম, কামাল উদ্দিন, নেত্রকোনার সাত্তার মিয়াসহ অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে গেয়েছেন। একসময় মালজোড়া গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

জগৎ এবং প্রাত্যহিক জীবনের মানবিক তাত্পর্য, মানবপ্রেম ও স্রষ্টাপ্রেম উদ্ভাসিত হয় তাঁর রচনায়। সুফি দর্শন, বাউল দর্শন ও সাধনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল তিনি। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল তাঁর বড় ধর্ম। সহজ ভাবনায়, সাদামাটা জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, নির্লোভ ও সরলতা প্রতিভাত হয় তাঁর চলনে-বলনে।

১৯৬৭ সালে প্রথম গীতিগ্রন্থ রত্নভার ছাড়াও আরও সাতটি বই প্রকাশিত হয় তাঁর জীবদ্দশায়। দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, জলভরা, রূপতত্ত্ব, বাঁশি, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মিলন, নিবেদন, ভাটিয়ালি, ভক্তিমূলক, রাধাকৃষ্ণ, আঞ্চলিক গান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন।

বাংলার মরমি সংগীতের অগ্রগণ্য বাউল গায়ক কফিলউদ্দিন সরকার ‘তত্ত্বের ভান্ডার’ নামে পরিচিতি লাভ করেন তাঁর অসামান্য দক্ষতায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজস্ব ভাবনা-রুচিবোধ-সমাজভাবনা-মনুষ্যত্ববোধ ও আনন্দ-বেদনা তুলে ধরেন গানে। তাঁর গীতবাণী নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গানগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

কফিলউদ্দিন সরকার ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিলেটের একটি হাসপাতালে। লোকসাহিত্যের নিভৃতচারী এই নক্ষত্র পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন নীরবে। কিন্তু আমাদের হৃদয়বীণায় বেজে ওঠে তাঁরই কণ্ঠে আকুল করা সেই গান-

‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, বাঁচি না পরানে গো, একেলা ঘরে রইতে পারি না’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

“নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে তথ্যমন্ত্রীর শোক”

আমি চাইলাম যারে…

আপডেট টাইম ০৯:০৮:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বাউল সাধক কফিলউদ্দিনের মৃতুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করে এই লেখা।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জনপদ আধ্যাত্মিক নগর সিলেট। সুফি, মরমি, বৈষ্ণব, সাধু, ফকিরেরা এ অঞ্চলকে করেছেন গরীয়ান। কালোত্তীর্ণ এই তীর্থভূমির সুপুরুষদেরই একজন কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর রচিত প্রায় পাঁচ হাজার গানের মধ্যে জনপ্রিয় একটি হলো-‘আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে, সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে।’

প্রান্তিক জনপদেও সাধক বা মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। যাঁরা জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণের বার্তা দিয়েছেন কবিতায়, গানের বাণীতে। এমনই এক সাধক কবি ‘জ্ঞানের সাগর’ খ্যাত দুরবিন শাহের অন্যতম শিষ্য কফিলউদ্দিন সরকার। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান কণ্ঠে তুলে খ্যাতি অর্জন করেছেন বহু কণ্ঠশিল্পী। তবু সিলেটের বাইরে তিনি রয়ে গেলেন অচেনা, অজানা। এক হাতে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাকে। ঠোঁটের সাহায্যে তাঁর মন্দিরা বাজানোর দৃশ্যে হৃদয়ে দাগ কাটে। অল্প সময়ে যেকোনো বিষয়ে গান লিখে দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।

১৯৩২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের মালঞ্চপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, মা করিমুন্নেসা। এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০ বছর বয়স থেকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

শিশুকাল থেকে রাত জেগে পালাগান শুনতে শুনতেই গানের জগতে প্রবেশ। যৌবনের সন্ধিক্ষণে গান লিখতে শুরু করেন। একতারা, দোতারা বাজিয়ে গাইতেন নিজের এবং বিভিন্ন মহাজনি গান। যৌবনকালে আখমাড়াইয়ের মেশিনে বাঁ হাতটি থেঁতলে যায়, কেটে ফেলতে হয় কনুই পর্যন্ত। বহু দুঃখ-দুর্দশায় জীবন কাটালেও থেমে থাকেনি তাঁর কণ্ঠ। শাহ আবদুল করিম, কামাল উদ্দিন, নেত্রকোনার সাত্তার মিয়াসহ অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে গেয়েছেন। একসময় মালজোড়া গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

জগৎ এবং প্রাত্যহিক জীবনের মানবিক তাত্পর্য, মানবপ্রেম ও স্রষ্টাপ্রেম উদ্ভাসিত হয় তাঁর রচনায়। সুফি দর্শন, বাউল দর্শন ও সাধনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল তিনি। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল তাঁর বড় ধর্ম। সহজ ভাবনায়, সাদামাটা জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, নির্লোভ ও সরলতা প্রতিভাত হয় তাঁর চলনে-বলনে।

১৯৬৭ সালে প্রথম গীতিগ্রন্থ রত্নভার ছাড়াও আরও সাতটি বই প্রকাশিত হয় তাঁর জীবদ্দশায়। দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, জলভরা, রূপতত্ত্ব, বাঁশি, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মিলন, নিবেদন, ভাটিয়ালি, ভক্তিমূলক, রাধাকৃষ্ণ, আঞ্চলিক গান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন।

বাংলার মরমি সংগীতের অগ্রগণ্য বাউল গায়ক কফিলউদ্দিন সরকার ‘তত্ত্বের ভান্ডার’ নামে পরিচিতি লাভ করেন তাঁর অসামান্য দক্ষতায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজস্ব ভাবনা-রুচিবোধ-সমাজভাবনা-মনুষ্যত্ববোধ ও আনন্দ-বেদনা তুলে ধরেন গানে। তাঁর গীতবাণী নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গানগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

কফিলউদ্দিন সরকার ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিলেটের একটি হাসপাতালে। লোকসাহিত্যের নিভৃতচারী এই নক্ষত্র পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন নীরবে। কিন্তু আমাদের হৃদয়বীণায় বেজে ওঠে তাঁরই কণ্ঠে আকুল করা সেই গান-

‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, বাঁচি না পরানে গো, একেলা ঘরে রইতে পারি না’