ঢাকা ০১:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
রামগড়ে পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্র জামে মসজিদ নিয়ে নানা বির্তক দ্রুত সমাধান চায় সাধারণ মুসল্লী ও এলাকাবাসী বগুড়ার শিবগঞ্জে ট্রাকচাপায় দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র নিহত রানীশংকৈল মডেল স্কুলের আলোচিত ধীরেন্দ্রনাথ সহ ৪ শিক্ষক বদলি । কুষ্টিয়ায় ব্যাংক কর্মকর্তার পুরুষাঙ্গ কর্তন মামলায় স্ত্রীর কারাদন্ড টাঙ্গাইলে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা, যুক্ত হচ্ছে মাদক সেবনের সাথেও জবি ছাত্রী অবন্তিকার আত্মহত্যা: সহপাঠি ও প্রক্টরের ২জনের রিমান্ড মঞ্জুর। “পাঁচ দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিড়ি শ্রমিকদের মানববন্ধন” যুবলীগ সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকবে.. দিদারুল ইসলাম চৌধুরী দুমকিতে ১২ ঘন্টার মধ্যে র‍্যাবের ফাঁদে পলায়নরত ধর্ষক আটক। সন্তানের চাকরি স্থায়ীকরন চেয়ে লক্ষ্মীপুরে পঙ্গু বাবার আকুতি

রাজনীতি আজ অবসরপ্রাপ্তদের ‘ভাউজ’

জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ—প্রথম চ্যান্সেলর বাংলার গভর্নর আলেকজান্ডার জর্জ রবার্ট বুলওয়ার লিটনের ভাষায়—‘গ্রেটেস্ট পজেশন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো গত শনিবার। প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯৫ বছর আগে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি। সেটি ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের আড়াই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে ৩০৪ জন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সেই ঐতিহাসিক সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৭৯ জন। তাঁরা গভর্নর লিটনের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করেন। ৩০৪ জনের মধ্যে কেন মাত্র ৭৯ জন উপস্থিত? অন্য ২২৫ জন কোথায় গেলেন? অত কম উপস্থিতির জন্য চ্যান্সেলর মৃদু ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ জে হার্টগ প্রকাশ করেন দুঃখ। প্রথম সমাবর্তনে ডিগ্রি নেন, এমন অনেকের থেকে জানা যায় কম উপস্থিতির কারণ। যাঁরা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাননি তাঁরাও কার্জন হল থেকে তিন–চার শ মিটার দূরে এদিক–ওদিক কোথাও ছিলেন। চ্যান্সেলর যখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসেন, দূর থেকে তাঁরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাঁকে দেখেছেন। রাজকীয় পোশাক পরা সুপুরুষ সুদর্শন স্যার আলেকজান্ডার লিটন। গভর্নরকে একনজর দেখে তাঁরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছেন মাত্র। ভালো জামা ও পাজামা বা প্যান্ট ছিল না বলে তাঁরা গভর্নরের সামনে উপস্থিত হতে সংকোচ বোধ করেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের অনুরোধে তাঁর সঙ্গে আমি সমাবর্তনের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়েছিলাম। সমাবর্তনের দিনও অন্য এক অনুষ্ঠানে ওই এলাকায় গিয়েছি। চোখ জুড়িয়ে গেল। হাজারো শিক্ষার্থীর কোলাহল। তাঁদের সমাবর্তনের পোশাক পরা। ছেলেমেয়েরা ছবি তুলছেন। বিভিন্ন পোজে সেলফি তুলছেন। কেউ মা–বাবার সঙ্গেও ছবি তুলছেন। সবারই অতি সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ। এঁদেরই কেউ আগামী দশকে প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করবেন। এবার যাঁরা ডিগ্রির সনদ নিলেন, তাঁদের অগ্রিম সাফল্য কামনা করি। এবং প্রত্যাশা করি, তাঁরা ভুলে যাবেন না জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্র তাঁদের পড়িয়েছে, বিনিময়ে জাতিকে তাঁদের কিছু দেওয়ার আছে, শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলা নয়।

উল্লেখ্য, এবার সমাবর্তনে ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েটকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়। তা ছাড়া, ৮১ জনকে পিএইচডি এবং ২৭ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এবার যাঁরা সমাবর্তনে ডিগ্রি পেলেন, ইচ্ছা করলে শুধু তাঁরাই বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন নিয়ে রচনা লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। সে জন্য উপযুক্ত যোগ্য ব্যক্তিরা রয়েছেন। সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কিছু প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন, যা বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। একালে বাংলাদেশে রাজনীতিতে যাঁরা লিপ্ত রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁদের আমি বিশেষ পছন্দ করি, জনাব আবদুল হামিদ তাঁদের একজন। নব্বইয়ের দশকে তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে তাঁর অপকটতা ও সারল্যে আমি মুগ্ধ। এবং আমি অনুমান করে গর্বিত যে তিনিও আমাকে পছন্দ করেন। সততা ও সারল্য অতি দুর্লভ মানবিক গুণ। সাদামনের মানুষই হাস্যরস করতে পারেন। গত ঈদের দিন রসিকতা করে বললেন, ‘লাস্ট জার্নির দিন আপনেরে নিয়া সমস্যা অইব না। ওই কাপড় পইরাই রইছেন। আমাগো জন্য কাপড় কেনন লাগব।’

দেবব্রত বিশ্বাস, জয়নুল আবেদিনের মতো জনাব আবদুল হামিদ তাঁর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জের ভাষা ধরে রেখেছেন; ‘শুদ্ধ বাংলা’ বলার চেষ্টা করেন না। কৃত্রিমতা তাঁর অপছন্দ। আজ অতি উঁচুতে উঠেও তিনি নিজেকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি আচার্য। সেখানে সমাবর্তনে গিয়ে অকপটে তিনি নিজের শিক্ষাজীবন ও আর্থসামাজিক অবস্থান নিয়ে কথা বলে আনন্দ পান। তা থেকেও শিক্ষার্থীদের শেখার আছে—যদি তাঁরা তাঁর কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করেন।

কী তাঁর যোগ্যতা, যা তাঁকে রাষ্ট্রের এই উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছে? এই আসনে গিয়ে তিনি তাঁর অতীতকে ভুলে না গিয়ে বারবার স্মরণ করেন এবং অন্যকে শোনান। আদি রসাত্মক কথাও বলেন। সেদিনের সমাবর্তনেও তিনি প্রেমপত্র লেখার কথা বলেছেন। সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কথাও বলেছেন। নিজেকে নিয়ে রসিকতা সবাই করতে পারেন না। তার জন্য অসামান্য আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহস প্রয়োজন।

জনাব আবদুল হামিদ বাংলাদেশের মৃত্তিকাসংলগ্ন রাজনীতিবিদের প্রতিভূ। ছাত্ররাজনীতি করেছেন মফস্বলে, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেননি। গত ৪৮ বছরে কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও আমি তাঁর এলাকায় গিয়েছি। দেখেছি সাধারণ মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসে। হাওরের মৎস্যজীবী, খেতের কৃষক, রাস্তার পাশের ছোট দোকানদার, চা-বিস্কুট বিক্রেতা তাঁকে ভালোবাসেন। তাঁকে তাঁরা ভালোবাসেন, কারণ তিনিও তাঁদের ভালোবাসেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নোংরামি ও প্রতারণার শেষ নেই। জনাব হামিদ তাঁর ভোটারদের সঙ্গে কখনো প্রতারণা করেননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মনে আঘাত দেননি। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে কটু ভাষায় আক্রমণ করেননি। খুব বেশি হলে হাস্যরস করেছেন। সে রসিকতা তাঁর প্রতিপক্ষও উপভোগ করেছেন।

আজীবন তিনি জনগণের মধ্যে থেকে রাজনীতিই শুধু করেছেন, অন্য কিছু নয়। সমাবর্তন ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ। অহন যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁরা তো ভাউজ চিনবেন না, ভাউজ হইল ভাবি। ভাইয়ের বউকে ভাবি বলি আমরা, গ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাবিদেরকে ভাউজ ডাকা হয়। আর গরিবের বউ হইলে মোটামুটি পাড়া বা গ্রামের সবাই আইস্যা ভাউজ ডাকে। অহন রাজনীতি হইয়া গেছে গরিবের বউয়ের মতন। এখানে যে কেউ, যেকোনো সময় ঢুইকা পড়তে পারে।…কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ। সবাই ইঞ্জিনিয়ার কইন, আর ডাক্তার কইন, এই ভিসি সাবও ৬৫ বছর হইলে কইব, আমিও রাজনীতি করুম। যারা সরকারি চাকরি করে, জজ সাবরা যারা আছে ৬৭ বছর চাকরি করবো। রিটায়ার্ড কইরা কইবো “আমিও রাজনীতি করিব”। আর্মির জেনারেল অয়, সেনাপ্রধান অয়, অনেকে রিটায়ারমেন্টে গিয়াই কয় “আমিও রাজনীতি করিব”। সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল, সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি বা জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রত্যেকেই রিটায়ার কইরা বলে “আমি রাজনীতি করিব”।…ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে, এটা যেন কেমন কেমন লাগে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের এমন ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করে। মনে মনে কই, আমরা রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়া কত পাছার মধ্যে বাড়ি দিছ। তুমি আবার আমার লগে আইছ রাজনীতি করতা। কই যামু?…যার জন্যে আমার মনে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না। শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার। সবাই চাকরি শেষ করে রাজনীতিতে ঢুকতে চায়—এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’

মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, তবে সময় থাকলে তিনি আরও ব্যাখ্যা করতেন। অবসরপ্রাপ্তরা সব দলের রাজনীতি করেন না, শুধু শাসক দল তাঁদের প্রিয়, সব দলের রাজনীতিতে মধু নেই। সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই। মন্ত্রী হওয়ার দরোজা বন্ধ। তাই কোনো অবসরপ্রাপ্ত কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে যান না, নাগরিক ঐক্যে যোগ দেন না, গণসংহতিতে যান না। তাঁদের পছন্দ যে দলে মধু আছে, সেই দল।

রাজনীতি যেন সবার ভাউজ না হয়, এখন জনগণের সেই সংগ্রাম করার সময় এসেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ।

Tag :

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

রামগড়ে পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্র জামে মসজিদ নিয়ে নানা বির্তক দ্রুত সমাধান চায় সাধারণ মুসল্লী ও এলাকাবাসী

রাজনীতি আজ অবসরপ্রাপ্তদের ‘ভাউজ’

আপডেট টাইম ০৮:১০:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর ২০১৮

জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ—প্রথম চ্যান্সেলর বাংলার গভর্নর আলেকজান্ডার জর্জ রবার্ট বুলওয়ার লিটনের ভাষায়—‘গ্রেটেস্ট পজেশন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো গত শনিবার। প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯৫ বছর আগে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি। সেটি ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের আড়াই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে ৩০৪ জন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সেই ঐতিহাসিক সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৭৯ জন। তাঁরা গভর্নর লিটনের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করেন। ৩০৪ জনের মধ্যে কেন মাত্র ৭৯ জন উপস্থিত? অন্য ২২৫ জন কোথায় গেলেন? অত কম উপস্থিতির জন্য চ্যান্সেলর মৃদু ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ জে হার্টগ প্রকাশ করেন দুঃখ। প্রথম সমাবর্তনে ডিগ্রি নেন, এমন অনেকের থেকে জানা যায় কম উপস্থিতির কারণ। যাঁরা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাননি তাঁরাও কার্জন হল থেকে তিন–চার শ মিটার দূরে এদিক–ওদিক কোথাও ছিলেন। চ্যান্সেলর যখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসেন, দূর থেকে তাঁরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাঁকে দেখেছেন। রাজকীয় পোশাক পরা সুপুরুষ সুদর্শন স্যার আলেকজান্ডার লিটন। গভর্নরকে একনজর দেখে তাঁরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছেন মাত্র। ভালো জামা ও পাজামা বা প্যান্ট ছিল না বলে তাঁরা গভর্নরের সামনে উপস্থিত হতে সংকোচ বোধ করেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের অনুরোধে তাঁর সঙ্গে আমি সমাবর্তনের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়েছিলাম। সমাবর্তনের দিনও অন্য এক অনুষ্ঠানে ওই এলাকায় গিয়েছি। চোখ জুড়িয়ে গেল। হাজারো শিক্ষার্থীর কোলাহল। তাঁদের সমাবর্তনের পোশাক পরা। ছেলেমেয়েরা ছবি তুলছেন। বিভিন্ন পোজে সেলফি তুলছেন। কেউ মা–বাবার সঙ্গেও ছবি তুলছেন। সবারই অতি সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ। এঁদেরই কেউ আগামী দশকে প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করবেন। এবার যাঁরা ডিগ্রির সনদ নিলেন, তাঁদের অগ্রিম সাফল্য কামনা করি। এবং প্রত্যাশা করি, তাঁরা ভুলে যাবেন না জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্র তাঁদের পড়িয়েছে, বিনিময়ে জাতিকে তাঁদের কিছু দেওয়ার আছে, শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলা নয়।

উল্লেখ্য, এবার সমাবর্তনে ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েটকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়। তা ছাড়া, ৮১ জনকে পিএইচডি এবং ২৭ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এবার যাঁরা সমাবর্তনে ডিগ্রি পেলেন, ইচ্ছা করলে শুধু তাঁরাই বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন নিয়ে রচনা লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। সে জন্য উপযুক্ত যোগ্য ব্যক্তিরা রয়েছেন। সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কিছু প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন, যা বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। একালে বাংলাদেশে রাজনীতিতে যাঁরা লিপ্ত রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁদের আমি বিশেষ পছন্দ করি, জনাব আবদুল হামিদ তাঁদের একজন। নব্বইয়ের দশকে তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে তাঁর অপকটতা ও সারল্যে আমি মুগ্ধ। এবং আমি অনুমান করে গর্বিত যে তিনিও আমাকে পছন্দ করেন। সততা ও সারল্য অতি দুর্লভ মানবিক গুণ। সাদামনের মানুষই হাস্যরস করতে পারেন। গত ঈদের দিন রসিকতা করে বললেন, ‘লাস্ট জার্নির দিন আপনেরে নিয়া সমস্যা অইব না। ওই কাপড় পইরাই রইছেন। আমাগো জন্য কাপড় কেনন লাগব।’

দেবব্রত বিশ্বাস, জয়নুল আবেদিনের মতো জনাব আবদুল হামিদ তাঁর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জের ভাষা ধরে রেখেছেন; ‘শুদ্ধ বাংলা’ বলার চেষ্টা করেন না। কৃত্রিমতা তাঁর অপছন্দ। আজ অতি উঁচুতে উঠেও তিনি নিজেকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি আচার্য। সেখানে সমাবর্তনে গিয়ে অকপটে তিনি নিজের শিক্ষাজীবন ও আর্থসামাজিক অবস্থান নিয়ে কথা বলে আনন্দ পান। তা থেকেও শিক্ষার্থীদের শেখার আছে—যদি তাঁরা তাঁর কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করেন।

কী তাঁর যোগ্যতা, যা তাঁকে রাষ্ট্রের এই উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছে? এই আসনে গিয়ে তিনি তাঁর অতীতকে ভুলে না গিয়ে বারবার স্মরণ করেন এবং অন্যকে শোনান। আদি রসাত্মক কথাও বলেন। সেদিনের সমাবর্তনেও তিনি প্রেমপত্র লেখার কথা বলেছেন। সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কথাও বলেছেন। নিজেকে নিয়ে রসিকতা সবাই করতে পারেন না। তার জন্য অসামান্য আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহস প্রয়োজন।

জনাব আবদুল হামিদ বাংলাদেশের মৃত্তিকাসংলগ্ন রাজনীতিবিদের প্রতিভূ। ছাত্ররাজনীতি করেছেন মফস্বলে, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেননি। গত ৪৮ বছরে কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও আমি তাঁর এলাকায় গিয়েছি। দেখেছি সাধারণ মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসে। হাওরের মৎস্যজীবী, খেতের কৃষক, রাস্তার পাশের ছোট দোকানদার, চা-বিস্কুট বিক্রেতা তাঁকে ভালোবাসেন। তাঁকে তাঁরা ভালোবাসেন, কারণ তিনিও তাঁদের ভালোবাসেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নোংরামি ও প্রতারণার শেষ নেই। জনাব হামিদ তাঁর ভোটারদের সঙ্গে কখনো প্রতারণা করেননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মনে আঘাত দেননি। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে কটু ভাষায় আক্রমণ করেননি। খুব বেশি হলে হাস্যরস করেছেন। সে রসিকতা তাঁর প্রতিপক্ষও উপভোগ করেছেন।

আজীবন তিনি জনগণের মধ্যে থেকে রাজনীতিই শুধু করেছেন, অন্য কিছু নয়। সমাবর্তন ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ। অহন যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁরা তো ভাউজ চিনবেন না, ভাউজ হইল ভাবি। ভাইয়ের বউকে ভাবি বলি আমরা, গ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাবিদেরকে ভাউজ ডাকা হয়। আর গরিবের বউ হইলে মোটামুটি পাড়া বা গ্রামের সবাই আইস্যা ভাউজ ডাকে। অহন রাজনীতি হইয়া গেছে গরিবের বউয়ের মতন। এখানে যে কেউ, যেকোনো সময় ঢুইকা পড়তে পারে।…কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ। সবাই ইঞ্জিনিয়ার কইন, আর ডাক্তার কইন, এই ভিসি সাবও ৬৫ বছর হইলে কইব, আমিও রাজনীতি করুম। যারা সরকারি চাকরি করে, জজ সাবরা যারা আছে ৬৭ বছর চাকরি করবো। রিটায়ার্ড কইরা কইবো “আমিও রাজনীতি করিব”। আর্মির জেনারেল অয়, সেনাপ্রধান অয়, অনেকে রিটায়ারমেন্টে গিয়াই কয় “আমিও রাজনীতি করিব”। সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল, সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি বা জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রত্যেকেই রিটায়ার কইরা বলে “আমি রাজনীতি করিব”।…ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে, এটা যেন কেমন কেমন লাগে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের এমন ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করে। মনে মনে কই, আমরা রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়া কত পাছার মধ্যে বাড়ি দিছ। তুমি আবার আমার লগে আইছ রাজনীতি করতা। কই যামু?…যার জন্যে আমার মনে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না। শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার। সবাই চাকরি শেষ করে রাজনীতিতে ঢুকতে চায়—এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’

মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, তবে সময় থাকলে তিনি আরও ব্যাখ্যা করতেন। অবসরপ্রাপ্তরা সব দলের রাজনীতি করেন না, শুধু শাসক দল তাঁদের প্রিয়, সব দলের রাজনীতিতে মধু নেই। সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই। মন্ত্রী হওয়ার দরোজা বন্ধ। তাই কোনো অবসরপ্রাপ্ত কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে যান না, নাগরিক ঐক্যে যোগ দেন না, গণসংহতিতে যান না। তাঁদের পছন্দ যে দলে মধু আছে, সেই দল।

রাজনীতি যেন সবার ভাউজ না হয়, এখন জনগণের সেই সংগ্রাম করার সময় এসেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ।